সমৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে চাই জাতীয় ঐকমত্য: রাষ্ট্রপতি

দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধিকে স্থায়ী রূপ দিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Jan 2020, 02:07 PM
Updated : 9 Jan 2020, 02:08 PM

গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, “জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না।

“গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই।”

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২০ সালের প্রথম অধিবেশনে ভাষণে একথা বলেন রাষ্ট্রপ্রধান আবদুল হামিদ। সংবিধান অনুযায়ী বছরের শুরুর অধিবেশন শুরু হয় রাষ্ট্রপতির ভাষণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়।

জাতীয় সংসদকে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে আইনসভাকে কার্যকর রাখতে সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেন রাষ্ট্রপতি।

“স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।”

 গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারে ভূমিকার প্রশংসা করেন আবদুল হামিদ।

তিনি বলেন, “শত প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি ও বৈরিতার মধ্যেও দেশে সুশাসন সুসংহতকরণ এবং গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।”

সদ্য শেষ হওয়া বছরে আলোচিত বিভিন্ন মামলার কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলা এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ড মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে এবং আদালত কর্তৃক দোষীদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।

“এছাড়া হলি আর্টিজান হামলা মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার রায় দ্রুত প্রদান করা হয়েছে। দুর্নীতি, জুয়া, মাদক, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে এবং জনজীবনে স্বস্তি বিরাজ করছে।”

প্রতিবারের মতো এবারও মন্ত্রিসভায় ঠিক করে দেওয়া ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়েন রাষ্ট্রপতি।

বিকাল ৪টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।

অধিবেশন শুরুর পর শোক প্রস্তাব গ্রহণ হয়। এর পর রেওয়াজ অনুযায়ী অধিবেশন মুলতবি করেন স্পিকার। পরে সন্ধ্যা ৬টায় আবার অধিবেশন শুরু হয়।

মুলতবি বৈঠক শুরুর পরে স্পিকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানকে সম্ভাষণ জানান।

সংসদ কক্ষে রাষ্ট্রপতি ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পিকারের ডান পাশে লাল রঙের গদি সম্বলিত চেয়ার রাখা হয়।

 স্পিকারের অনুরোধের পর রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। এসময় তার মূল বক্তব্য পঠিত বলে গণ্য করার জন্য স্পিকার শিরীন শারমিনকে অনুরোধ জানান আবদুল হামিদ।

স্পিকারের আসনের বাম পাশে রাখা ‘রোস্ট্রামে’ দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন আবদুল হাদি, যিনি নিজে এক সময় এই সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

১৬৩ পৃষ্ঠার ভাষণের সংক্ষিপ্তসারে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন।

এছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি।

“দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার রায় কার্যকর করা হয়েছে এবং পলাতক আসামিদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”

আবদুল হামিদ বলেন, “শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি পালন করব।

“আমাদের দৃষ্টি ২০২১ সাল ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে, ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে - এটাই জাতির প্রত্যাশা।”

তিনি বলেন, “আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ন এবং সমাজের সকল স্তরে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সরকার নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনসহ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হবো।

“ইতিহাসের সাহসী সন্তানেরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এ দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সমুন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে দেশ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ-প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে বাঙালি জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।”

আবদুল হামিদ বলেন, “একাত্তরের শহিদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে। আসুন, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহিদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি।”

মুজিববর্ষ উদযাপনের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, “এবছর উদ্‌যাপিত হবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। জাতির পিতার জীবনাদর্শ, জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তার অব্যাহত সংগ্রাম, নির্ভীক, দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব এবং তার গভীর দেশপ্রেম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত।

“নতুন প্রজন্মের কাছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে জাতির পিতার জীবন দর্শন ও কর্ম বিশেষভাবে উপস্থাপনের  জন্য মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপনের বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।”

রাষ্ট্রপতি জানান, জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে বিষয়ভিত্তিক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে মোট ২৯৩টি কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭ মার্চ ২০২০ হতে ১৭ মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মুজিববর্ষে দেশ ও দেশের বাইরে সরকারি কর্মসূচি ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা সকলেই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে যার যার নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে।

ভাষণ শেষ হলে সংসদ সদস্যরা টেবিল চাপড়ে রাষ্ট্রপতিকে অভিবাদন জানান। পরে স্পিকার সোমবার পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করেন।