ধর্ষণস্থল সড়কের পাশে হলেও ঝোপ-ঝাড়ে অন্ধকার

রাজধানীর কুর্মিটোলায় যে স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষিত হন, বিমানবন্দর সড়কের পাশের সেই স্থানটি ঝোপঝাড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে সন্ধ্যা থেকেই। সেখানে সড়কে বাতি থাকলেও তার অধিকাংশই জ্বলে না।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Jan 2020, 03:42 PM
Updated : 26 August 2020, 11:47 AM

কুর্মিটোলা হাসপাতালের ফটক থেকে প্রায় তিনশ গজ উত্তরে আর্মি গলফ ক্লাবের ফটক পর্যন্ত এই পথে অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়ে আসছে বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

রোববার সন্ধ্যায় বাস থেকে নামার পর ওই পথ ধরে চলার সময় তুলে সড়কের পাশে নিয়ে ধর্ষণ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে।

সহপাঠীরা জানান, শেওড়ায় তার এক বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষণিকা বাসে উঠেছিলেন ওই তরুণী। ভুল করে এক স্টপেজ আগে কুর্মিটোলায় নেমে পড়ার পর ফুটপাথ ধরে সামনে এগুচ্ছিলেন তিনি।

কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কের এই স্থান ধরে সামনে এগোলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

ওই শিক্ষার্থীর বরাত দিয়ে ঢাকা মেডিকেল ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, “সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাস থেকে নামার পরপরই অজ্ঞাতপরিচয় কোনো লোক তার মুখ চেপে ধরে এবং পাশের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে তিনি চেতনা হারান।”

সড়ক থেকে কয়েক গজ দূরের ওই জায়গা থেকে নির্যাতিত মেয়েটির ওড়না ও স্যান্ডেলসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র সোমবার উদ্ধার করে পুলিশ।

ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জায়গাটি অতটা নির্জন না হলেও একটি বড় গাছের আড়ালে সামান্য ঝোঁপ রয়েছে।”

সোমবার বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কুমিটোলা হাসপাতালের সামনে থেকে শেওড়া পর্যন্ত এক কিলোমিটার সড়কের পাশে কোনো দোকানপাট কিংবা মানুষের বিচরণ নেই। এর মধ্যে কুর্মিটোলা থেকে আর্মি গলফ ক্লাবের প্রবেশ মুখ পর্যন্ত প্রায় তিনশ (তিন মিনিট হাঁটা দূরত্ব) ফুটপাতের পাশ কৃত্রিম ঝোঁপ ঝাড়ে ভরা।

দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করার কারণে ফুটপাত থেকে ঝোপের ভেতরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ব্যস্ত সড়কে একের পর এক গাড়ি ছুটতে থাকায় উচ্চ শব্দের কারণে ঝোঁপের ভেতরে চিৎকার করলেও তা কারও শুনতে পাওয়া কঠিন।

সড়কের পাশে ডিজিটাল যাত্রী ছাউনি, বিভিন্ন সৌন্দর্য বর্ধন ও গাছ লাগানোর ইজারা নিয়েছে ভিনাইল গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আবিদ মনসুরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরে কথা বলবেন।

পরে আবার তাকে ফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি।

কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের প্রতিবাদে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেওয়া এক শিক্ষার্থী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী, যারা ঢাবির ক্ষণিকা বাসে করে এই পথে চলাচল করেন।

এদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোনায়েম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাস্তার পাশে বাগানবিলাস ঝোঁপের দুটি স্তর সৃষ্টি হয়ে আছে। দুই স্তরের ঝোঁপের পরই রয়েছে আর্মি গলফ ক্লাবের দেয়াল। সেই দেয়ালটিও কার্টেইন ক্রিপার লতায় ঢাকা। এই দেয়ালের পরেই রয়েছে গলফ ক্লাবের একমুখী রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েও কেউ সাধারণত হাঁটে না। সেখানেও কেবল প্রাইভেটকার বা মোটর সাইকেল চলাচল করে।

“এখানে সড়কের পাশে কোনো বাতি জ্বলে না। সন্ধ্যা হলেই এখানে অন্ধকার নেমে আসে। এখানে বার বার অপরাধের ঘটনা ঘটলেও নেই কোনো প্রহরী।”

কুর্মিটোলায় বিমানবন্দর সড়কের এই স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

তার কথা সমর্থন করে জোয়ার সাহারা এলাকার বাসিন্দা প্রিয়াংকা বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানে প্রায়ই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

“কিছুদিন আগেও কুর্মিটোলা হাসপাতালে আমার মামি চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। যাওয়ার পথে দিনের বেলায় এই স্থানটি থেকে মামির গোল্ডের জিনিসপত্র ছিনতাই হয়ে যায়। চুরি-ছিনতাইয়ের জন্য এটা একটি মোক্ষম জায়গা। সন্ধ্যার পরে যখন অন্ধকার নেমে আসে, তখন দেখার কেউ থাকে না।”

সন্ধ্যার পর সরেজমিনে দেখা যায়, ওই স্থানটিতে উজ্জ্বল কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। কিছু রঙিন বাতি থাকলেও তার অধিকাংশই জ্বলে না। এসব রঙিন বাতিতে আবার মানুষের মুখ চেনার উপায়ও নেই।

কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনাস্থল থেকে সোমবার দুপুরে আলামত সংগ্রহ করে সিআইডি।

গুলিস্তান থেকে টঙ্গীতে যাতায়াতকারী বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহনের এক চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুর্মিটোলা হাসপাতালের সামনে থেকে শেওড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এই জায়গাটা একেবারেই নিরব থাকে। রাত হলে এখানে অন্ধকার হয়ে যায়; বাতি জ্বলে না।

“এখান দিয়ে কোনো লোক দেখাই যায় না। ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা না ঘরে সেজন্য এখানে আলোর ব্যবস্থা করা, প্রহরী নিয়োগ দেওয়া এবং ঝোপ পরিষ্কার করা উচিৎ।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান শুভ ৫ বছর ক্ষণিকা বাসে চলাচল করতেন। সম্প্রতি তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছেন।

শুভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে এমইএস স্টপেজে তাদের গাড়ি থামলেও ২০১৮ সালে বাসের শিক্ষার্থীদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে তা নিয়ে আসা হয় কুর্মিটোলায়। কিন্তু ফুটপাথের নিরাপত্তাহীনতার দিকটি দেখে তখনও তারা কুর্মিটোলায় স্টপেজের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা একমত হতে না পারায় কুর্মিটোলা থেকে স্টপেজটি সরেনি।

ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ এখনও অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারেনি। এদিকে সোমবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল বিক্ষোভে উত্তাল।