নতুন বইয়ের উৎসবে মাতোয়ারা দেশ

শীতের সকালের মিষ্টি রোদে হাতে হাতে নতুন বই, চোখে মুখে খুশির ছটা; নতুন বছরের প্রথম দিন সারা দেশে স্কুলশিশুরা মেতেছে নতুন বইয়ের উৎসবে।

নিজস্ব প্রতিবেদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ও সাভার প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2020, 10:25 AM
Updated : 1 Jan 2020, 01:07 PM

প্রাথমিক পেরিয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠা রাইসা জান চোখে মুখে সেই আনন্দ নিয়ে বললো, “নতুন বই উৎসবের জন্য আমরা অপেক্ষা করি। নতুন বইয়ের গন্ধটাই তো অন্যরকম!”

বুধবার দেশের সব স্কুলে এই উৎসবের মধ্য দিয়ে চার কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ১৫৮ ছাত্রছাত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৭ কপি পাঠ্যবই।

পাঁচটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের বই এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ব্র্রেইল বইও রয়েছে এর মধ্যে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার গণভবনে কয়েকজন শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিয়ে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেছিলেন।

আর বুধবার সকালে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের এবং সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।

অধরচন্দ্র স্কুলের পাঠ্যপুস্তক উৎসবের সূচনা হয় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। পরে বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

বক্তৃতার শুরুতেই সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আগামী দিনে বাংলাদেশ যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখে, আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর যে পথ, সেখানে পৌঁছানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় আমাদের শিক্ষা। এবং সেই শিক্ষার উন্নয়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।”

বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তেই যে ২০১০ সাল থেকে সকল শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া শুরু হয়েছিল, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে দীপু মনি বলেন, গত দশ বছরে মোট ৪৩ কোটি ১৯ লাখ ২৭ হাজার ৭৩৯ জন শিক্ষার্থীর হাতে ৩৩১ কোটি ৪৭ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৯টি বই তুলে দেওয়া হয়েছে।

“আমাদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করবার জন্য আমরা আরো বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। আমরা যুগপোযুগী পাঠ্যবই প্রণয়ন করছি। আমরা আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করছি, যাতে শিক্ষার্থীদের উপরে পরীক্ষার চাপ কমানো যায়, শিক্ষাকে আনন্দময় করা যায়।”

আর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, “তুমি স্বপ্ন দেখবে, তোমার সকলে স্বপ্ন দেখবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তোমরা পরিশ্রম করবে, মনোযোগী হবে, পড়াশোনার দিকে মন দিবে, মনোযোগ দিয়ে পড়বে। দেশকে জানার জন্য তোমরা সব সময় সচেতন থাকবে। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ সহিংসতা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে। গুজবে কান দেবে না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে তোমরা দায়িত্বশীল হবে, আমরা চাই তোমরা সবাই ভালো মানুষ হবে।”

বছরের প্রথম দিন বুধবার সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বই উৎসবে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

সাভারের অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বছরের প্রথম দিন বুধবার পাঠ্যপুস্তক উৎসবে নতুন বই হাতে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা।

সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার পেছনে না ছুটে শেখার দিকে আরও মনোযোগ দিতে বলেন চিকিৎসা ও আইনের ডিগ্রিধারী রাজনীতিবিদ দীপু মনি।

“শুধু আমরা জিপিএ-৫, জিপিএ-৫ এই উন্মাদনার পেছনে যেন না ছুটি। আমার যা পড়ার আছে তা আমি পড়ব, শিখব, চেষ্টা করব আমার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো করতে। কিন্তু আমাকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে এজন্য আমি পড়াশোনা ছাড়া কিছুই করব না, শরীর চর্চায় সময় দিব না, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেব না, তাহলে হবে না। সবকিছু মিলিয়েই একজন পরিপূর্ণ মানুষ আমাদের হতে হবে।”

মানবিকতা, সততা, পরমতসহিষ্ণুতা, পরিচ্ছন্নতা, সহমর্মিতা ও দেশপ্রেমের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের আত্মস্থ করতে বলেন শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমাদের বঙ্গবন্ধু যে সোনার মানুষ চেয়েছিলেন, সেই সোনার মানুষ এর মধ্য দিয়েই আমরা তৈরি করতে পারব, তাদের হাতেই তৈরি হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ।”

ছোটবেলায় শেখা ব্রতচারী গানের কথা ‘মানুষ হ, মানুষ হ, আবার তোরা মানুষ হ, বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙ্গালী হ’ শিক্ষার্থীদের শুনিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “আমরা বাঙালি হয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে তার আদর্শকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি, তার মধ্যে দিয়ে আমরা মানুষ হয়ে উঠি।”

অন্যদের মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যরিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা, কারিগরি মাদ্রসা শিক্ষা বোর্ডের সচিব মুন্সী সাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, সাভার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে বেলা ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে হাজারো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বেলুন উড়িয়ে প্রাথমিক ও প্রাক প্রাথমিকের বই উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, "দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে দক্ষ মানব সম্পদের বিকল্প নেই। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আর শিক্ষার মূল ভিত্তি হল প্রাথমিক শিক্ষা।"

তিনি বলেন, "২০৪১ সালে আমরা উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সেই উন্নত বাংলাদেশের সুফল ভোগ করবে এই শিক্ষার্থীরা। আগামী দিনে এই শিক্ষার্থীরা জাতিগঠন, দেশগঠনে নেতৃত্ব দিবে।"

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য তিনি বলেন, "আমি তোমাদের অনুরোধ করব ভালোভাবে লেখাপড়া করে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে হবে। যাতে করে বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া সোনার বাংলা গড়তে পারি।"

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, সাংসদ শিরিন আক্তার, নজরুল ইসলাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম-আল-হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকার কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের আগে বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন তুলে দেওয়া হয়। শিক্ষক-অভিভাবকরাও যোগ দেন এই উৎসবে।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজে বই উৎসবের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নির্মল রঞ্জন গুহ ও সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আফজালুর রহমান বাবু।

বই হাতে পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সদ্য সপ্তম শ্রেণিতে ওঠা ফারিহা খানম বললো, “সপ্তম শ্রেণির বই তো আগেই দেখে ফেলেছি। আজ সেই বইগুলো হাতে পেলাম। কী আনন্দ!”