দুই সমাপনীর ফলে খুশি সবাই, তাগিদ মানোন্নয়নে

বড় কোনো উত্থান-পতন নেই, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও ছিল না; এবারের পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনীর ফলাফল নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের কণ্ঠে ঝরলো সন্তোষ।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2019, 04:46 PM
Updated : 31 Dec 2019, 05:27 PM

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এবার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপরই জোর দেওয়া উচিৎ সরকারের; আর সরকারও তা মানছে।

এবারের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে কিছু ‘ইতিবাচক দিক’ দেখতে পাচ্ছেন জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টায় এখন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার।

রেওয়াজ অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকালে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

একই অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন এবারের প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের সারসংক্ষেপ সরকারপ্রধানের হাতে তুলে দেন।

প্রাথমিক সমাপনীতে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইবতেদায়ীতে ৯৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে এবার। প্রাথমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৮ জন; আর ইবতেদায়ীতে ১১ হাজার ৮৭৭ জন পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে।

অন্যদিকে জেএসসি-জেডিসিতে এবার পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী; ৭৮ হাজার ৪২৯ জন পেয়েছে জিপিএ-৫।

নোটিস বোর্ডে পরীক্ষার ফলের খোঁজে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের এক শিক্ষার্থী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনায় প্রাথমিক সমাপনীতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা গতবারের তুলনায় সামান্য কমলেও জেএসসি-জেডিসিতে তা বেড়েছে।

শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষা আমরা দিতে চাই। যেন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা চলতে পারে। সেই শিক্ষাই আমাদের লক্ষ্য।

পরে অষ্টমের সমাপনীর ফলাফল নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “শিক্ষার জায়গায় আমরা গুণগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি, মানকে উন্নত করার চেষ্টা করছি; সেখানে পুরো মাইন্ডসেটটা পরিবর্তন করে দেখতে হবে কোন কোন বিষয়গুলোকে জোর দেব, কোনগুলোকে বড় করে দেখতে হবে।”

জিপিএ-৫ নিয়ে মাতামাতি না করে শিক্ষার্থীদের প্রতিভা বিকশিত করতে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন শিক্ষামন্ত্রী।

“আমার মনে হয় আমরা যত কম জিপিএ-৫ নিয়ে কথা বলি তত আমাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভালো। আমাদের জিপিএ-৫ এর উন্মাদনা… এটি দিয়ে আমরা আমাদের শিশুদের, শিক্ষার্থীদের পুরো শিক্ষা জীবনটাকে একেবারে নিরানন্দময়তো করছেই, তার সঙ্গে বিষিয়ে দিচ্ছি প্রায়।

“তাদের উপর যে অবিশ্বাস্য রকমের চাপ, পরিবারের দিক থেকে, বন্ধু-বান্ধবের দিক থেকে, জিপিএ-৫ই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না।”

দীপু মনি বলেন, “জিপিএ-৫ জিনিসটা আসলে আমাদের মাথা থেকে বের করে দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে শিখছে কি না, তাদের নিজেদের যে প্রতিভা আছে সেটি বিকশিত করার ক্ষেত্রে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে পারছি কি না, এই বিষয়গুলোই এখন মুখ্য হওয়া উচিত।”

অষ্টমের পর পঞ্চমেও একটি সমাপনী পরীক্ষা এবং তাতে বড়দের মত ৫ ভিত্তিক জিপিএর ব্যবস্থা যে প্রাথমিকের কোমলমতি শিশুদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, শেখার ওপর জোর না দিয়ে অভিভাবকরা যে কোনো প্রকারে সন্তানের জিপিএ-৫ পাওয়াকেই যে গুরুত্ব দিচ্ছেন- সে কথা কয়েক বছর ধরেই বলে আসছিলেন শিক্ষবিদরা।   

গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করা সম্ভব।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সদিচ্ছা থাকলেই কাজটা হয়। সংখ্যাগত (ফলাফলের) দিক থেকে আমরা এগিয়েছি, এখন গুণগত দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।”

কোচিং সেন্টার আর গাইড বইয়ের দৌরাত্মের কথা তুলে ধরে রাশেদা বলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষ এবং শিক্ষা- এই দুই মন্ত্রণালয়ের কাছেই প্রত্যাশা, লেখাপড়াকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে, কারণ এটা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে চলে গেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে, এখানে কার্পণ্য করলে হবে না।

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্ন তুলে রাশেদা বলেন, শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষানীতি বাস্তাবায়ন করতে হবে, সমন্বিত শিক্ষা আইনও করতে হবে।

ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংগঠন 'অভিভাবক ফোরামের' চেয়ারম্যান জিয়াউল কবীর দুলুও মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষা আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, শিক্ষা আইন বাস্তবায়ন করে গাইড বই নিষিদ্ধ করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান জোরদার করতে হবে, শিক্ষকদের সৃজনশীলতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

পঞ্চমের সমাপনী পরীক্ষা তুলে দেওয়ার দাবি রেখে দুলু বলেন, “অভিভাবকরা এই পরীক্ষা চান না। কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

“শিক্ষাখাত থেকে দুর্নীতি দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষার জন্য বাজেটে যতটুকু বরাদ্দ হয় ততটুকু কাজে লাগাতে হবে। শিক্ষাখাতের দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।”

প্রাথমিক ও ইবতেদায়ী সমাপনীর ফলাফর ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের কাছে প্রাথমিকের সমাপনী তুলে দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে তিনি বলেন, “মায়েরা এত বেশি টানাটানি করে জিপিএ-টিপিয়ে নিয়ে… আমরা চিন্তা করছি পরীক্ষাটা… মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও কথা হল এটার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা, পরীক্ষা রাখা হবে, এই পরীক্ষাটা উনি রাখতে চাচ্ছেন। এটা একটু সহজ করা যায় কীভাবে, যাতে টানা-হেঁচড়া না থাকে।”

অষ্টমে বেড়েছে পাসের হার-জিপিএ-৫

জেএসসি-জেডিসিতে পাসের হারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এই পরীক্ষায় এবার ৮৭ দশমিক ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭৮ হাজার ৪২৯ জন।

গত বছর জেএসসি-জেডিসিতে সম্মিলিতভাবে ৮৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করে। তাদের মধ্যে ৬৮ হাজার ৯৫ জন জিপিএ-৫ পায়।

নয়টি সাধারণ বোর্ডে এবার গড় পাসের হার ৮৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। আর মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

এই ফলাফলে সন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাসহ সমগ্র শিক্ষা পরিবারের সার্বিক সহযোগিতায় এ অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।”

জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার ফলাফল ৫ ভিত্তিক জিপিএর পরিবর্তে ৪ ভিত্তিক জিপিএতে করার সিদ্ধান্ত ২০২০ সাল থেকে কার্যকর করা হতে পারে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান শিক্ষামন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমরা বলেছিলাম এ বছর কার্যকর করতে পারি কি না, কিন্তু মনে হল এবার করতে গেলে অনেক বেশি তাড়াহুড়ো হবে, তাড়াহুড়ো করে একটা জিনিস পরিবর্তন করা- এটা বোধহয় সমীচীন হবে না। আমরা পুরোটাই বিশ্লেষণ করে দেখে আগামী বছর থেকে শুরু করব বলে আশা করছি।”

“পাবলিক পরীক্ষা ছাড়া সমাপনী পরীক্ষাগুলোতে পুরো গ্রেডিং সিস্টেমটা তুলে দিয়ে কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।”

পঞ্চমে কমেছে পাসের হার

প্রাথমিক সমাপনীতে এবার ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইবতেদায়ীতে ৯৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। প্রাথমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৮ জন। আর ইবতেদায়ীতে পূর্ণ জিপিএ পেয়েছে ১১ হাজার ৮৭৭ জন।

গত বছর প্রাথমিক সমাপনীতে ৯৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ ও ইবতেদায়ীতে ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। সেই হিসেবে এবার প্রাথমিকে পাসের হার কমেছে ২ দশমিক ০৯ শতাংশ পয়েন্ট। আর ইবতেদায়ীতে পাসের হার কমেছে ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ পয়েন্ট।

প্রাথমিকে কেন পাসের হার কমল- সেই প্রশ্নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব আকরাম আল হোসেন বলেন, “এতদিন যে উপজেলার খাতা সেই উপজেলায় মূল্যায়ন করা হত। এবার আমরা পরিবর্তন করে দিয়েছি। মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে হয়তো কিছুটা কমতে পারে।”

এবার এক উপজেলার উত্তরপত্র অন্য উপজেলায় পাঠিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। সার্বিক ফলাফলে পাসের হারের পাশাপাশি এবার পঞ্চমের সমাপনীতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে।

জেএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর মঙ্গলবার মোবাইল ফোনে পরীক্ষার ফল দেখছেন হলিক্রস স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেন, “সব বছর তো পাসের হার এক রকম থাকবে না। এবার আমরা সুন্দরভাবে পরীক্ষা নিয়েছি, পরীক্ষায় কোনো দুর্নীতি করতে দিইনি, ইত্যাদি কারণে হয়ত পরীক্ষা সঠিকভাবে হয়েছে। কিছুটা সুন্দর মূল্যায়ন হয়েছে হয়তোবা, এটাই হয়তো কারণ।”

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এফ এম মঞ্জুর কাদির বলেন, পাসের হার প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বাড়বে না।

“তাহলে তো ১০০ ক্রস করে যাবে। কখনও কমবে, কখনও বাড়বে। প্রশ্ন হয়তো এবার সেভাবেই হয়েছে, যার ফলে পাস কমে এসেছে। এমসিকিউ তুলে দেওয়া হয়েছে, এর একটা প্রভাব থাকতে পারে।”

প্রাথমিক সমাপনীতে এতদিন এমসিকিউ বা বহু নির্বাচনী প্রশ্ন থাকলেও এবার থেকে শতভাগ প্রশ্ন সৃজনশীল পদ্ধতিতে করা হয়েছে।

এমসিকিউ তুলে দিলেও পরীক্ষার সময় না বাড়ানোয় ফলাফলে তার প্রভাব পড়েছে কি না, সেই প্রশ্নে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা মনে করি না। আমাদের কোনো কর্মকর্তাও এটা বলেননি যে বাচ্চারা সময় পাচ্ছে না।”