মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য মতে, এ বছর বাংলাদেশে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ৩৮৮ জন মানুষ ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ‘ শিকার হয়েছেন।
এ বছর গুমের অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা কম হলেও বছরজুড়ে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ‘উদ্বেগজনক ছিল’ বলে আসকের অভিমত।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার মধ্যে নারী ধর্ষণ, দলবেঁধে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও হতাহতের বহু ঘটনা ঘটেছে। আর বছরের মাঝামঝিতে এসে ‘ছেলেধরা’ গুজবে গণপিটুনিতে অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০১৯: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন আসক কর্মকর্তারা।
আসকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক নিনা গোস্বামী প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও দলবেঁধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৪১৩ জন নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ৭৩২ নারী এবং ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮১৮।
এ বছর নারীদের উত্ত্যক্ত করা ও যৌন হয়রানির ঘটনাও বেড়েছে বলে আসকের পরিসংখ্যান।
তারা বলছে, ২০১৯ সালে ২৫৮ জন নারী যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৪৪ পুরুষ। উত্ত্যক্তের কারণে ১৮ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে চার নারীসহ ১৭ জন খুন হয়েছেন।
গত বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে শিশু নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ বছর শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ ও নিখোঁজের পর মোট ৪৮৭টি শিশু নিহত হয়েছে, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪১৯টি।
২০১৯ সালে ৩৮৮ জন ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হওয়ার তথ্য দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “২০১৮ সালের ৯ মার্চ মাদকবিরোধী এক সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘ক্রসফায়ার’ নয়, আত্মরক্ষার খাতিরেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি ছোড়ে। যা প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করে।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে এ বছর ১৮৭ জন নিহতের তথ্য দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
“এ বছর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ৩৭ জন এবং তাদের শারীরিক নির্যাতনের কারেণ ছয় জনসহ মোট ৪৩ জন মারা গেছেন।”
এ বছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ১৩ জন অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হয়েছেন, তাদের মধ্যে পরবর্তিতে পাঁচজনের সন্ধান পাওয়া গেলেও বাকি আটজন এখনও নিখোঁজ বলে আসকের ভাষ্য।
বছরজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ‘বাঁধা এসেছে’ বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া এ বছর ১৪২ জন সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতন, হামলা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে এ বছর দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় ৭২টি প্রতীমা ভাংচুর, হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৯টি বাড়িঘর ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে আহত হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের ৫১ জন ব্যক্তি।
আর বছরের মাঝামাঝিতে ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ গুজব ছড়ানো হয়। হঠাৎ করে ছেলে ধরা আতঙ্কের মধ্যে নিরীহ মানুষদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ বছর গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৬৫ জন।
এসব বিষয় তুলে ধরে আসক সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশও করেছে। এগুলো হল- এ পর্যন্ত সংঘটিত সব গুম, অপহরণ ও ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকণ্ডের’ অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে সহযোগিতা দিতে সরকারের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে আসকের মহাসচিব আহমিনা রহমান, নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবিরসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।