২০১৯: বাংলাদেশ হারাল যাদের

নানা সম্মাননা আর অর্জনের বছর ছিল ২০১৯; উৎসব আর আনন্দের উপলক্ষও এসেছে বারবার। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি বা সাহিত্য অঙ্গনের এমন ক’জন ব্যক্তিত্বকে এ বছর হারিয়েছে বাংলাদেশ, যাদের ক্ষতি কখনও পূরণ হওয়ার নয় বলে বিশিষ্টজনরা মনে করেন। 

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2019, 03:31 AM
Updated : 31 Dec 2019, 03:31 AM
 

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

বছরের শুরুতেই বাংলাদেশ হারায় আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। ব্যাংককের হাসপাতালে কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩ জানুয়ারি মৃত্যু হয় তার।  ৬৮ বছর বয়সী সৈয়দ আশরাফ ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

সৈয়দ আশরাফ মৃত্যুর আগে আওয়ামী লীগে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হাসপাতালে থেকেই তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-১ নৌকার প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে শপথ নিতে পারেননি তিনি।

১৯৭৫ সালের অগাস্ট ট্র্যাজেডির পর নভেম্বরে কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর বিরূপ পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন আশরাফ। লন্ডনে নির্বাসিত জীবনে প্রবাসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখেন সৈয়দ নজরুলের এই ছেলে।

দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আশরাফ। এরপর ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ সালেও নির্বাচিত হন।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফ ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার মধ্যে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলের হাল ধরেন। ওই বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে পরে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন তিনি।

২০১৭ সালে স্ত্রী শীলা আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে নিজেও অসুস্থ ছিলেন আশরাফ। মন্ত্রিসভার কাজেও অনিয়মিত ছিলেন তিনি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদ থেকেও ৯০ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন তিনি।

 

আল মাহমু‌দ

‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আল মাহমুদ রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জানুয়ারি মারা যান। ৮২ বছর বয়সী আল মাহমুদ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আল মাহমুদ। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামে মা-বাবার পাশে শেষ শয্যা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদের। শেষ জীবনে আল মাহমুদের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা দিলেও কবি হিসেবেই তার পরিচয়টিই বড় করে দেখেন সাহিত্যমোদীরা।

 

আমানুল্লাহ কবীর

সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবীর চিরবিদায় নেন ১৬ জানুয়ারি, ৭২ বছর বয়সে। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি ডায়াবেটিস ও লিভারের নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পাশাপাশি এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও পেশাজীবীদের মধ্যে নেতৃত্বের কাতারে ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর।

১৯৪৭ সালের ২৪ জানুয়ারি জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন আমানুল্লাহ কবীর। দীর্ঘ পেশাজীবনে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষার সংবাদপত্রেই তিনি কাজ করেছেন। ১৯৯১ সালে এস এম আলীর সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রকাশিত হলে তার প্রথম বার্তা সম্পাদক ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর। ওই বছরের শেষ দিকে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফে যোগ দেন তিনি। বেক্সিমকোর মালিকানায় দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন আমানুল্লাহ কবীর। পরে বিএনপি সরকারের সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যম বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। আমানুল্লাহ কবীরের সম্পাদনায় ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় বাংলা দৈনিক আমার দেশ। প্রায় পাঁচ দশকের পেশা জীবনের শেষ সময়ে, শেষ পাঁচটি বছর আমানুল্লাহ কবীর ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে।

১৯৮০ আর ৯০ এর দশকে সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন আমানুল্লাহ কবীর। সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো তখনও দলীয় মেরুকরণে বিভক্ত হয়নি। অবিভক্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই মেয়াদে মহাসচিব এবং পরে সভাপতি ছিলেন তিনি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল

চার দশকের সুরের মায়া কাটিয়ে ২২ জানুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বরেণ্য সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।একুশে পদক পাওয়া এই গানের মানুষটির বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

দুইশর বেশি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে গেছেন তিনি। ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’র মত দেশাত্মবোধক গানে তার দেওয়া সুর বাংলাদেশের মানুষের বুকে চিরদিন বাজবে। 

১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসালমীর সাবেক আমীর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দিতে এসে সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল।

২০১২ সালের অগাস্টে বুলবুল ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার পরের বছর খুন হন তার ছোট ভাই আহমেদ মিরাজ। ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে কুড়িল ফ্লাইওভারের পাশ থেকে পুলিশ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে। সেই ঘটনার বিচার না পাওয়ায় হতাশা ছিল বুলবুলের মনে।

প্রেমের তাজমহল সিনেমার জন্য তিনি ২০০১ সালে এবং হাজার বছর ধরে সিনেমার জন্য ২০০৫ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। 

দেশের সংগীত অঙ্গনে অবদানের জন্য ২০১০ সালে সরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

 

শাহ আলমগীর

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক সাংবাদিক মো. শাহ আলমগীর মারা যান ২৮ ফেব্রুয়ারি।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শাহ আলমগীরের বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। ২০১৩ সালের ৭ জুলাই থেকে তিনি পিআইবির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

পিআইবিতে যোগ দেওয়ার আগে এশিয়ান টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও প্রধান সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন শাহ আলমগীর।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে লেখাপড়া করা শাহ আলমগীরের সাংবাদিকতার শুরু উপমহাদেশের প্রথম শিশু-কিশোর সাপ্তাহিক কিশোর বাংলায়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ওই পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন তিনি।

এরপর দৈনিক জনতা, বাংলার বাণী, আজাদ ও সংবাদ-এ কাজ করা আলমগীর ১৯৯৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম বার্তা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া চ্যানেল আইয়ে প্রধান বার্তা সম্পাদক, একুশে টেলিভিশনে হেড অব নিউজ, যমুনা টেলিভিশনে পরিচালক (বার্তা) এবং মাছরাঙা টেলিভিশনে বার্তা প্রধানের দায়িত্বেও তিনি ছিলেন।

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা শাহ আলমগীর জাতীয় প্রেস ক্লাবেরও সদস্য ছিলেন।

 

পলান সরকার

বই পড়ায় উদ্বুদ্ধ করতে রাজশাহীর গ্রামে গ্রামে নিজের টাকায় বই বিলি করে অভিনব এক আন্দোলনের সূচনা করা পলান সরকারের জীবনযাত্রা থেমে যায় ১ মার্চ।

৯৮ বছর বয়সী পলান সরকার বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে পালন সরকারকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

১৯২১ সালে নাটোরে জন্ম নেওয়া পলান সরকারের আসল নাম হারেজ উদ্দিন। তবে স্থানীয়দের কাছে তিনি পলান সরকার নামেই পরিচিত।

শৈশবে বাবাকে হারানো পলান আর্থিক সংকটে প্রাথমিকের পর আর পড়তে পারেননি। তবে তার বই পড়া কখনও থামেনি। তারুণ্যে এক যাত্রাদলে যোগ দিয়ে ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন পলান সরকার। ওই সময় থেকেই তার বই পড়ার নেশা বাড়তে থাকে।

প্রতিবছর স্কুলের মেধাতালিকায় যারা প্রথম দশটি স্থান পেত, তাদের ১৯৯০ সাল থেকে বই উপহার দেওয়ার নিয়ম চালু করেন পলান সরকার।

এরপর অন্য শিক্ষার্থীরাও বইয়ের আবদার করলে তিনি ঠিক করেন, বই তিনি সবাইকেই দেবেন, তবে তা পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে।

এভাবেই শুরু হয় পলান সরকারের বই পড়া আন্দোলন। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে নিয়ম করে হাঁটা শুরু করেন তিনি। তার সঙ্গেই তিনি যোগ করে নেন বই বিলি করার বিষয়টি। প্রতিদিন সকালে পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বাড়ি বাড়ি নতুন বই দেওয়া আর পুরনো বই ফেরত নেওয়া শুরু করেন তিনি।  

শুরুতে তার এই আন্দোলনের কথা রাজশাহীর কয়েকটি গ্রামের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০০৬ সালে বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে পলান সরকারের নাম ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

 

শাহনাজ রহমত উল্লাহ

‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে, এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ বহু জনপ্রিয় গানের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহ মারা যান ২৪ মার্চ।

শাহনাজ রহমত উল্লাহর জন্ম ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি, ঢাকায়। তার ভাই প্রয়াত আনোয়ার পারভেজ ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন জনপ্রিয় নায়ক।

একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী শাহনাজ রহমত উল্লাহর গানের শুরু স্কুল জীবন থেকেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। এরপর বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। টেলিভিশনে গাইতে শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। সত্তরের দশকে অনেক উর্দু গীত ও গজল গেয়েছেন শাহনাজ।

২০০৫ সালে বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান পায়।

সঙ্গীতে অবদানের জন্য একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি।

 

টেলি সামাদ

চলচ্চিত্রে অভিনয়ে মানুষকে হাসিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আবদুস সামাদ ভক্তদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন ৬ এপ্রিল। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

আবদুস সামাদ ‘টেলি সামাদ’ হিসেবেই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন; টেলিভিশন থেকে চলচ্চিত্রে পা রাখায় তার এই নাম হয়ে যায়, যা তিনি নিজেও আর বদলাননি।

মুন্সীগঞ্জ শহরের উপকন্ঠ নয়াগাঁও এলাকার সন্তান সামাদ। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা সামাদ তার বড়ভাই চারুশিল্পী আব্দুল হাইকে অনুসরণ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়।

১৯৭৩ সালে ‘কার বউ’ দিয়ে চলচ্চিত্রে পা রাখেন সামাদ। গত চার দশকে ৬০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তার অভিনীত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘জিরো ডিগ্রী’।

কমেডিয়ান হিসেবে দর্শক টেলি সামাদকে চিনলেও প্রায় ৪০টির বেশি চলচ্চিত্রে গানও গেয়েছেন টেলি সামাদ। ‘মনা পাগলা’ ছবির সংগীত পরিচালনাও করেন তিনি।

 

সুবীর নন্দী

অর্ধশতকের সংগীত জীবনে বাংলা গানের ভুবনে বহু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী চিরবিদায় নেন ৭ মে।

দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগতে থাকা ৬৬ বছর বয়সী এই শিল্পী চিকিৎসাধীন ছিলেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে।

২০১৯ সালের ২০ ফ্রেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে একুশে পদক নেন সুবীর নন্দী।

১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্লেব্যাকে আসেন সুবীর । ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’। সেই সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিন আর সুবীর নন্দীর কণ্ঠে ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আড়াই হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দেওয়া সুবীর নন্দী চার বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চার বার বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন।

এপ্রিলেই যান টেলিভিশন ও মঞ্চ অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মাহফুজ উল্লাহ, অভিনেতা সালেহ আহমেদ ও সাবেক মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ ও অভিনেতা টেলি সামাদ।

 

খালিদ হোসেন

একুশে পদকপ্রাপ্ত নজরুল সংগীত শিল্পী ও গবেষক খালিদ হোসেনের সুর সাধনা থেমে যায় ২২ মে। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

১৯৪০ সালের ৪ ডিসেম্বর কলকাতায় জন্ম খালিদ হোসেনের। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশে নজরুল গীতির শিক্ষক, গবেষক ও শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডে সংগীত নিয়ে প্রশিক্ষক ও নিরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুল সংগীতের আদি সুরভিত্তিক নজরুল স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের সদস্য তিনি।
এ পর্যন্ত তার ছয়টি নজরুল সংগীতের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তার একমাত্র আধুনিক গানের অ্যালবাম ‘চম্পা নদীর তীরে’। এ ছাড়া তার ১২টি ইসলামী গানের অ্যালবামও রয়েছে।

নজরুল সংগীতে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পান খালিদ হোসেন।

 

নাট্যকার মমতাজউদদীন

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অভিনেতা, নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২ জুন।

৮৪ বছর বয়সী মমতাজউদদীন নাট্যচর্চায় অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক পান ১৯৯৭ সালে। এছাড়া বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।

১৯৩৫ সনে ১৮ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মালদহে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার পূর্ববঙ্গে চলে আসে।

রাজশাহী সরকারি কলেজে পড়ার সময়ই রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। রাজশাহীর তৎকালীন ছাত্রনেতা ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুর সান্নিধ্যে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগঠনে তিনি ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির রাতে রাজশাহী সরকারি কলেজের মুসলিম হোস্টেলের ইট কাদামাটি দিয়ে যে শহীদ মিনার গড়ে উঠেছিল, তাতে মমতাজউদ্দীনও ভূমিকা রেখেছিলেন। তখন জেল খেটেছেন একাধিকবার।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসেবে মমতাজউদ্দীনের কর্মজীবনের শুরু। পরে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন।

এছাড়াও মে মাসে বাংলাদেশ হারায় একুশে পদকজয়ী বাংলাদেশি নজরুল সংগীতশিল্পী ও নজরুল গবেষক খালিদ হোসেন, মঞ্চ অভিনেত্রী মায়া ঘোষ, কবি ও সাহিত্য সমালোচক হায়াৎ সাইফকে।

 

ঝর্ণাধারা চৌধুরী

গান্ধীবাদী চেতনায় মানুষ আর সমাজের সেবায় পুরো জীবন পার করে ২৭ জুন চিরবিদায় নেন ঝর্ণাধারা চৌধুরী।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টি বোর্ডের সচিব ঝর্ণাধারা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেন ঝর্ণাধারা চৌধুরী। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে ঝর্ণাধারা যোগ দেন গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত অম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্টে। সেটাই এখন গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট নামে পরিচিত।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ঝর্ণাধারা চৌধুরী ২০১৩ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হন। বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া বেগম রোকেয়া পদকসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা সম্মাননা পেয়েছেন এই সমাজকর্মী।

মে দিবসে রোববার ঢাকার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সমাবেশে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। ছবি: আসাদুজ্জামান প্রামানিক

 

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ

গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তিন দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব নিয়ে থাকা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবনাবসান ঘটে ১৪ জুলাই।

৯০ বছর বয়সী এরশাদ রক্তের ক্যান্সার মাইডোলিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন; শেষ দিকে তার ফুসফুসে দেখা দিয়েছিল সংক্রমণ, কিডনিও কাজ করছিল না।

গত ২২ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হলে রাখা হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে, সেখান থেকে আর জীবনে ফেরা হয়নি তার।

গত কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এরশাদ। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের শেষ ভাগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব একটা দেখা যায়নি তাকে।

মৃত্যুর পর এরশাদের কবর নিয়ে দেখা দেয় দলে বিভেদ। প্রথমে ঢাকায় দাফনের কথা জানানো হলেও লাশ রংপুরে নিয়ে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের চাপে সেখানেই পৈত্রিক বাড়িতে শেষ শয্যা হয় সাবেক এই সামরিক শাসকের।   

মৃত্যুর আগে নিজের সম্পত্তি ট্রাস্টে দিয়ে যান এরশাদ। অসুস্থতার কারণে ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও বসিয়ে যান তিনি।

নানা বিতর্কের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত ছিলেন এরশাদ। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটল। 

 

রিজিয়া রহমান

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অগ্রজ কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান মারা যান গত ১৬ অগাস্ট। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

১৯৩৯ সালে কলকাতার ভবানীপুরে রিজিয়া রহমানের জন্ম। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি এপার বাংলায় চলে আসেন।

শৈশব থেকে জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আর নানা জায়গায় দেখা নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের গল্প উঠে এসেছে রিজিয়া রহমানের লেখায়। বস্তিবাসীর ক্লেদাক্ত জীবন আর যৌনপল্লীর যন্ত্রণাকাতর প্রাত্যহিকতা যেমন তার উপন্যাসে এসেছে, তেমনি চট্টগ্রামে পর্তুগিজ জলদস্যুদের উৎপাত আর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্বও তার লেখায় প্রেরণা যুগিয়েছে।

সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান রিজিয়া রহমান। আর সরকার এ বছরই তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। রিজিয়া রহমান বেশ কিছুদিন একটি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যপরিচালক এবং জাতীয় জাদুঘরের পরিচালনা বোর্ডের ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

মোজাফফর আহমদ

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপের সভাপতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মারা যান ২৩ অগাস্ট।

তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র জীবিত সদস্য ছিলেন তিনি।

মোজাফফর আহমদের জন্ম ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল, কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোজাফফর আহমদ এই আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখেন।

ষাটের দশকের শেষ ভাগে বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থি দুই ধারা স্পষ্ট হয়। এ নিয়ে মতবিরোধ থেকে মাওলানা ভাসানী থেকে আলাদা হয়ে যান অধ্যাপক মোজাফফর। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ চীনপন্থি, আর ন্যাপ মোজাফফর হয় মস্কোপন্থি।

১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করা হলে তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকেও সদস্য করা হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও নেননি।

কালিদাস কর্মকার

বাংলাদেশে স্থাপনা শিল্প ও পারফরমেন্স শিল্পের সূচনাকারী অন্যতম শিল্পী কালিদাস কর্মকার মারা যান ১৮ অক্টোবর।  তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।

সেদিন বাসার বাথরুমে অচেতন অবস্থায় পাওয়ার পর পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন কালিদাসকে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ।

১৯৪৬ সালে ফরিদপুরে কালিদাস কর্মকারের জন্ম। ১৯৬৯ সালে কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে তিনি চারুকলায় স্নাতক ডিগ্রি পান।

বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রশিল্পে ভিন্ন মাধ্যম ও আঙ্গিক প্রবর্তনে যারা অগ্রণী, কলিদাস কর্মকার তাদেরই একজন। ইয়োরোপীয় আধুনিকতার ঘরানার এই শিল্পী মিশ্র মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন বাংলার মাটির পাললিক গল্প।  

চারুকলায় অবদানের জন্য সরকার ২০১৮ সালে কালিদাসকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

 

সাদেক হোসেন খোকা

অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা গত ৪ নভেম্বর নিউ ইয়র্কের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ক্যান্সারে আক্রান্ত খোকা গত পাঁচ বছর ধরেই নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। গত ১৮ অক্টোবর থেকে তিনি ভর্তি ছিলেন ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার সেন্টারে। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।

১৯৫২ সালের ১২ মে মুন্সীগঞ্জে সৈয়দপুরে সাদেক হোসেন খোকার জন্ম। তবে বাবা-মায়ের সঙ্গে বড় হয়েছেন ঢাকার গোপীবাগে।

মুক্তিযোদ্ধা খোকা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ থেকে বিএনপিতে এসেছিলেন শুরুতেই। ব্রাদার্স ইউনিয়নের সূত্রে বিএনপির ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি খোকার ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও পরিচিত রয়েছে।

সাদেক হোসেন খোকা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র এবং খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার মৎস্য ও পশু সম্পদমন্ত্রী ছিলেন। ঢাকার সূত্রাপুর-কোতোয়ালি আসন থেকে তিনি চারবার সংসদে গিয়েছিলেন।

একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে খোকা যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি ছিলেন গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ঢাকার কয়েকটি স্থানে গেরিলা অপারেশনের পাশাপাশি কুমিল্লায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি।

 

মইন উদ্দীন খান বাদল

৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ জাসদের নেতা মইন উদ্দীন খান বাদল ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

৬৭ বছর বয়সী মইন উদ্দীন খান বাদল চট্টগ্রাম-৮ (চাঁন্দগাও-বোয়ালখালী) আসনের তিনবারের সাংসদ। বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মইন উদ্দীন খান বাদল। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াসে’ যুক্ত বাদল একাত্তরে ভারতে প্রশিক্ষণ নেন এবং পরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন বাদল। জাসদ হয়ে বাসদ এবং পরে আবারও জাসদে ফেরেন। এরশাদের সামরিক শাসনের সময় তাকে কারাগারে যেতে হয়।

 

রবিউল হুসাইন

একুশে পদকজয়ী কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন রাজধানীর বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২৬ নভেম্বর।

৭৬ বছর রবিউল হুসাইন রক্তের জটিলতায় ভুগছিলেন। ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে একুশে পদক পাওয়া রবিউল হুসাইন কাজ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের জন্যও। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্রের ট্রাস্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী পরিষদের সদস্য।

স্থপতি রবিউলের ঝোঁক ছিল ইটের কাজের দিকে। তার নকশায় বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ কাউন্সিল (বিএআরসি) ভবনটি ছিল তার প্রিয় একটি কাজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তি ও স্বাধীনতা তোরণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট, ভাসানী হল, বঙ্গবন্ধু হল, শেখ হাসিনা হল, খালেদা জিয়া হল, ওয়াজেদ মিয়া সায়েন্স কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটরিয়াম ও একাডেমিক ভবন কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে রবিউল হুসাইনের নকশায়।

একুশে পদক ছাড়াও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার ও সার্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এই কবি।

 

রওশন আরা বাচ্চু

বায়ান্নোর উত্তাল একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় মেয়েদের যে মিছিল পুলিশের ব্যারিকেডে ভেঙেছিল, সেই মিছিলের মুখ রওশন আরা বাচ্চু মারা যান ৩ ডিসেম্বর।

মৌলভীবাজার জেলা কুলাউড়া থানার উছলাপাড়া গ্রামে ১৯৩২ সালের ১৭ই ডিসেম্বর রওশন আরা বাচ্চুর জন্ম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার দিনগুলোতেই রওশন আরা গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্টে যোগ দিয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। সেদিন তার নেতৃত্বেই ইডেন মহিলা কলেজ এবং বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমাবেশস্থলে সমবেত হয়।

এছাড়াও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ হারিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মো. আব্দুল কাদির, সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শ্যামল কান্তি বিশ্বাসকে।

 

মাহফুজুর রহমান খান

দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান মারা যান এ বছর ৬ ডিসেম্বর। ৭০ বছর বয়সী মাহফুজুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন।

১৯৪৯ সালের ১৯ মে পুরান ঢাকার হেকিম হাবিবুর রহমান রোডে জন্মগ্রহণ করেন মাহফুজুর রহমান খান। পেশাদার চিত্রগ্রাহক হিসেবে তিনি ১৯৭২ সালে প্রথম চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

শ্রাবণ মেঘের দিন, ঘেটুপুত্র কমলা, আগুনের পরশমণিসহ অনেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি।

শাহবাগে শুক্রবার গণজাগরণ মঞ্চের সংহতি সমাবেশে অধ্যাপক অজয় রায়,গত ফেব্রুয়ারিতে যার ছেলে লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ছবি: নয়ন কুমার

 

অজয় রায়

গত ৯ ডিসেম্বর চেলে যান শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় রায়। ৮৩ বছর বয়সী অধ্যাপক অজয় রায় ফুসফুসের সংক্রমণের পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় তিনি ভুগছিলেন।

ছেলে অভিজিৎ রায় জঙ্গি হামলায় নিহত হওয়ার পর ভেঙে গিয়েছিল মন, ছেলে হত্যার বিচার শেষ হওয়ার আগেই চিরবিদায় নেন তিনি।

শিক্ষায় অবদানের জন্য একুশে পদক পাওয়া অজয় রায় ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩৬ সালে দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করা অজয় রায়ের শিক্ষকতার শুরু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ১৯৫৯ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে। ২০০০ সালে অবসরের পরও ইউজিসি অধ্যাপক ছিলেন তিনি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় অজয় রায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেন।

বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার আন্দোলনে অধ্যাপক অজয় রায় যতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসারের কাজেও তিনি ছিলেন সামনের কাতারে।

১৯৭২ সালে ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ব্র্যাক, যেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও।

 

স্যার ফজলে হাসান আবেদ

বাংলাদেশের মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করার চেষ্টায় নিরন্তর সংগ্রামের একটি জীবন পার করে গত ২০ ডিসেম্বর চিরবিদায় নেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।

১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণকারী ফজলে হাসান আবেদের উচ্চতর পড়াশোনা হয় লন্ডনে, হিসাব বিজ্ঞানে।

ফজলে হাসান আবেদ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি চাকরি ছেড়ে চলে যান লন্ডনে, সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠনে কাজ শুরু করেন। স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে আসেন তিনি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্বাবলম্বী করার প্রয়াসে ১৯৭২ সালে ফজলে হাসান আবেদের হাত ধরে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি (ব্র্যাক) নামে ব্র্যাকের কাজ শুরু হয়, যেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও।

৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থার নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন ফজলে হাসান আবেদ। ৬৫ বছর বয়সে নির্বাহী পরিচালকের পদ ছেড়ে চেয়ারপারসন হন তিনি। কয়েক মাস আগে তিনি চেয়ারপারসনের পদ ছেড়ে অবসরে যান।

১৯৮০ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার পাওয়া ফজলে হাসান আবেদ জীবনে অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, স্পেনিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, অফিসার ইন দ্য অর্ডার অফ অরেঞ্জ-নাসাউ, লিউ টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল ইত্যাদি।

২০১৪ ও ২০১৭ সালে ফরচুন ম্যাগাজিনের নির্বাচিত ৫০ বিশ্বনেতার মধ্যে ফজলে হাসান আবেদের নাম স্থান পেয়েছিল। দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন ফজলে হাসান আবেদ।

 

তালুকদার মনিরুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জামান মারা যান ২৯ ডিসেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

১৯৩৮ সালের ১ জুলাই সিরাজগঞ্জের তারাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তালুকদার মনিরুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৬ সালে অবসরে যান তিনি। ওই বছরই সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক মনোনীত করে।

 

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী 

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও ভারতে বাংলাদেশের সাবেক হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী মারা যান বছরের অন্তিম লগ্নে ৩০ ডিসেম্বর। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজা সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর জন্ম ১৯৪৪ সালে সিলেটে। তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৬৮ সালে।

১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে কর্মরত অবস্থায় বিদ্রোহ করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দেন মোয়াজ্জেম আলী। এরপর ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ভুটান, ইরান ও ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা মোয়াজ্জেম আলী বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে ইউনেস্কোর কাছে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস খসড়া প্রতিবেদন দিয়ে ভাষা আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতেও ভূমিকা রাখেন।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন মোয়াজ্জেম আলী। মেয়াদ শেষে গত নভেম্বরেই তিনি দেশে ফিরেছিলেন।