নূরের ওপর হামলায় ‘কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই’ ছাত্রলীগের

ডাকসু ভবনে ভিপি নুরুল হক নূর ও তার সহযোগীদের ওপর হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন এই সংগঠন থেকে নির্বাচিত ডাকসু প্রতিনিধিরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2019, 01:06 PM
Updated : 29 Dec 2019, 01:08 PM

রোববার ডাকসু ভবনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, “আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ডাকসু ভবনের ঘটনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মনোনীত কোনো ডাকসু প্রতিনিধির বিন্দুমাত্রও সংশ্লিষ্টতা নেই। আমরা স্পষ্টভাবে আরও বলতে চাই যে, উল্লেখিত সংঘর্ষ, হামলা-প্রতি হামলার সাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কেউ কোনোভাবেই জড়িত নয়।”

সংবাদ সম্মেলনে সাদ্দামের সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাহরিমা তানজিম অর্ণি, সাহিত্য সম্পাদক মাজহারুল কবির শয়ন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদার, ক্রীড়া সম্পাদক শাকিল আহমেদ তানভীর, সদস্য রকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য, তানভীর হাসান সৈকত, তিলোত্তমা শিকদার, রাইসা নাসের, মুহা. মাহমুদুল হাসান, চিবল সাংমা, রফিকুল ইসলাম সবুজ প্রমুখ।

তবে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে নির্বাচিত ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী উপস্থিত ছিলেন না। ‘ব্যক্তিগত কারণে’ রাব্বানী সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি বলে জানান সাদ্দাম।

সাদ্দাম ডাকসু ভবনে হামলার ঘটনাকে ‘ন্যক্কারজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “এই ঘটনাটি ঘটে ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর ও তার সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামক একটি সংগঠনের উপর গত ১৭ ডিসেম্বর তারিখে হামলার জের ধরে।”

এই দুটি সংগঠন ‘মিডিয়াবাজির’ মাধ্যমে পরিচিতি লাভের আশায় এই সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হামলার দিনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে সাদ্দাম বলেন, “পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও হামলার এক পর্যায়ে নূর ডাকসু ভবনে অবস্থান গ্রহণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ভবনের বাইরে। ভবনের দরজা বন্ধ করে ভিতরে নূর তার বহিরাগত সঙ্গীদের নিয়ে বাঁশ, লাঠি, রড, পাইপ সজ্জিত অবস্থায় মারমুখী থাকে যার ভিডিও আমরা দেখতে পাই নূরের নিজ ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পরিচালিত সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে।

“আমরা আরও দেখতে পাই, নূরের সঙ্গীরা ঢিল ছুঁড়ে ডাকসুর জানালার গ্লাস ভেঙে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের উপর হামলা চালায়। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে আমরা লক্ষ করি, নূরের সহযোগীরা ডাকসুর বারান্দায় সশস্ত্র অবস্থায় দলবেঁধে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের উপর সংঘর্ষে লিপ্ত হবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবার দৃশ্য। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ডাকসু ভবনের বাইরে অবস্থান করে নিজেদের শক্তির জানান দেয়। এতে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের আবেগের, আমাদের পরম আরাধ্য, পবিত্র ডাকসু ভবন।”

লিখিত বক্তব্যে সাদ্দাম বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমর্থনে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এই পালটাপাল্টি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা সম্পর্কে জানা মাত্রই যে যেখানে ছিলাম ছুটে আসার চেষ্টা করি ডাকসু ভবনকে রক্ষার এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য।

“কিন্তু হামলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সমর্থকদের নিবৃত করতে সফল হলেও ভবনের ভিতরে অবস্থিত ভিপি নূরের সমর্থকদের হামলা ও ঢিল ছোড়া বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় ডাকসু মনোনীত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য সনজিত চন্দ্র দাস এবং আমি ভবনের নিচে উপস্থিত হই। ডাকসু ভবনের নিচে এসে আমরা প্রথমেই বিক্ষুব্ধ মুক্তিয্দ্ধু মঞ্চের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ পরিহার করে স্থান ত্যাগ করার আহ্বান জানাই। আমাদের আহ্বানে মু্ক্তিয্দ্ধু মঞ্চ পিছু হটে। এরপর ডাকসুতে কর্মরত স্টাফরা দরজা খুলে দিলে সিনেট সদস্য সনজিত ও আমি ভিপি নূরের কক্ষে গিয়ে তাকেও সংঘর্ষ পরিহারের আহ্বান জানাই, যেমনটি জানানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের প্রতি। একইসাথে আমরা নূরকে আহ্বান জানাই, উপস্থিত বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসু ভবন ত্যাগ করার জন্য যাতে চলমান সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে।

“নূর এ আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উল্টো সিনেট সদস্য সনজিতের সাথে অসৌজন্যমূলক, ধর্মীয় উসকানিমূলক ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন। এরপর পুনরায় নূরকে বহিরাগতদের নিয়ে ডাকসু ভবন ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে আমরা অবরুদ্ধ ডাকসুর আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিষয়ক সম্পাদক শাহরিমা তানজিন অর্নি ও সদস্য রাইসা নাসেরকে উদ্ধার করে ডাকসু ভবন ত্যাগ করি। আমরা ত্যাগ করার পর বিবদমান দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্যার উপস্থিত হয়ে সংঘর্ষ থামান এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”

এই ঘটনার পর নূর ভিপি পদে থাকার ‘যোগ্যতা হারিয়েছেন’ দাবি করে ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পবিত্র আমানত ডাকসু ভবনকে রক্ষা না করে বরং এই ভবনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে এই নিজের লেলিয়ে দেওয়া বহিরাগত বাহিনী দিয়ে ভবনে ভাংচুরে অংশগ্রহণ করে নূর ভিপি পদে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা আবারও হারিয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি।”

এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছয়টি দাবি জানান ছাত্রলীগ থেকে ডাকসুর প্রতিনিধিরা। তাদের দাবিগুলো হল-

# ডাকসু নেতৃবৃন্দ, সিনেট সদস্য, হল সংসদের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের নামে মামলার অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে।

# ডাকসু ভবনের ভিতরে অবস্থিত নূরের সহযোগী বহিরাগতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

# ডাকসু ভবন ভাংচুরের সাথে জড়িত উভয় পক্ষের সদস্যদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

# ডাকসু ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিতকরণ ও আইনের আওতায় আনতে হবে।

# ‘দুর্নীতির দায়ে’ অভিযুক্ত ডাকসু ভিপিকে পদত্যাগ করতে হবে। নূরের ‘দুর্নীতি’ তদন্তে কমিটি গঠন করতে হবে।

# সাম্প্রদায়িক ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য দেওয়ায় নূরকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, অন্যথায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সংবাদ সম্মেলন

দুপুরে টিএসসিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে ভিপি নূরের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ভিপি নূরসহ তার সমর্থকদের উপর ‘অন্যায়-অবিচার’ করা হচ্ছে, যাতে তাদের মানবাধিকার ও আইনের শাসন ‘লংঘিত’ হচ্ছে।

এজন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তারা।

পরিষদের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, ডাকসু ভবনে হামলায় আহত তাদের যে সব  সহকর্মী ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি আছেন তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ ‘লুকোচুরি করছেন’।

পরিষদের যুগ্ন আহ্বায়ক বিন ইয়ামিন মোল্লা তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাকে ‘নীল নকশা’ অভিযোগ করে বলেন, “আমরা মোটেও মামলা-হামলায় বিচলিত নই। আমরা শোকে সন্তপ্ত থাকতে পারি, কিন্তু আমরা নড়বড় হয়ে যাইনি।”

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন, পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান, মাহফুজুর রহমান, আকরাম হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

হামলার তথ্য-প্রমাণ দিতে সময় বৃদ্ধি

ডাকসু ভবনে হামলার ঘটনায় তথ্য-প্রমাণ দিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আবারও আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গঠন করা তদন্ত কমিটি।

রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ডাকসুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঘটনা সম্পর্কে তথ্য দিতে আগ্রহী ব্যক্তিদের নিকট থেকে ঘটনার বিবরণসহ (প্রমাণ যদি থাকে) আগামী ৩০ ডিসেম্বর বেলা ২টার মধ্যে লিখিতভাবে তথ্য প্রদানকারীর নাম, ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বরসহ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ডিন, কলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর দপ্তরে সংরক্ষিত বক্সে জমা দেয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।”

তদন্তের স্বার্থে তথ্যদাতার নাম-ঠিকানা গোপন রাখা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য-প্রমাণ দিতে শনিবার পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।

ডাকসু ভবনে হামলাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ ও ‘দুঃখজনক’ আখ্যায়িত করে ঘটনার পরদিন ২৩ ডিসেম্বর ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে ছয় কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।

রোববার কমিটির প্রধান কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুক্র-শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য এবং অনেক কম তথ্য-প্রমাণ জমা হওয়ায় আমরা এই সময়টাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেই। অন্য কোনো কারণে নয়।”