রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি বিদায়ী বছরে প্রায়ই আলোচনায় এসেছে। কয়েক দফা চেষ্টা চললেও রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভেস্তে যায়। তাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগও সফল হয়নি।
এমন অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘতর হচ্ছে বলেই মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও কূটনীতিকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “প্রত্যাবাসনটা কখন হবে, সেটা আসলে বলা মুশকিল। আবার দ্রুত সময়ে হবে না, সেটাও আমরা বলতে পারি না। কারণ সত্তর ও নব্বইয়ের দশকে দেখেছি, হুট করে বড় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
”সবকিছু মিলিয়ে আমাদের উদ্যোগ হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।”
রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরাতে ইউরোপীয় বিভন্ন দেশ, ভারত এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বন্ধুপ্রতীম চীনকে এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী করতে সরকারকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দেন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের এই পরিচালক।
সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। তবে সেখানে গণহারে হত্যা-ধর্ষণ-জ্বালাও পোড়াওয়ের অভিযোগ মিয়ানমার অস্বীকার করে আসছে।
মিয়ানমার বলে আসছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু তাদের কথায় রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় গত অগাস্টে প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় দফা চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
এর বিপরীতে ক্যাম্পবন্দী জীবন পার করছে রোহিঙ্গারা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তার উপর চলা এই শরণার্থীদের নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও রয়েছে অস্বস্তি।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর প্রতি সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে আসলেও কারও উদ্যোগ এখন পর্যন্ত প্রত্যাবাসনে সফলতা বয়ে আনেনি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনের পাশাপাশি তাদের অনেকের অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিও ছিল বছরজুড়ে আলোচনায়। এর মধ্যে মাদক চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাদের অনেকেকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ দিতে হয়েছে।
পরিচয় গোপন করে রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নাম উঠানোর ঘটনাও চিন্তায় ফেলেছে নির্বাচন কমিশনকে। এসব ঘটনায় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে।
দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মিয়ানমার ১৯৮৪ সালের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে বলে নভেম্বরে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) অভিযোগ করে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া।
১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দ্য হেগের পিস প্যালেসে গাম্বিয়ার পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করতে এসে দেশটির আইনমন্ত্রী আবুবকর তামবাদু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানান।
পরদিন ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দিতে এসে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে গাম্বিয়া যে চিত্র আদালতে উপস্থাপন করেছে তা ‘অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর’।
অং সান সু চি দ্য হেগের আদালতে যে সেনাবাহিনীর পক্ষ হয়ে লড়ছেন, সেই সেনাবাহিনীই এক সময় তাকে বছরের পর বছর গৃহবন্দি করে রেখেছিল।
নিজের দেশে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় সু চি এখন সেই সেনাবাহিনীকে রক্ষার জন্য পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে শুনানিতে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা এবং গণহত্যার আলামত সংরক্ষণের আদেশ চাওয়া হয় আইসিজের কাছে।
তবে সেটা যদি প্রমাণও হয় তবুও অং সান সু চি কিংবা মিয়ানমারের জেনারেলদের গ্রেপ্তার করা কিংবা তাদেরকে বিচার করার মত পদক্ষেপ নিতে পারবে না আইসিজে।
মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত রায় দিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ আসতে পারে। এতে মিয়ানমার বিশ্বে ভাবমূর্তি হারানো এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের ১৫ বিচারকের সঙ্গে প্যানেলে আছেন গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মনোনীত দুই বিচারক। তিনদিনের শুনানি নিয়ে গাম্বিয়ার অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের বিষয়টি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রেখেছে আইসিজে।
মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক আদালতের মুখোমুখি করাকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করে এক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বিচার আদালত একটা পদক্ষেপ নেবে আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও একটি পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক একটা দিক। এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং ইউরোপীয় দেশসহ অন্যদের বোঝানোর কাজটা আমাদের করতে হবে।
”যাতে তারা মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে মিয়ানমারও বুঝতে পারবে, সমস্যা সমাধানে তাদের উদ্যোগী হতেই হচ্ছে। আর চীনকেও বড় আকারে বোঝানোর প্রয়োজন আছে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে।”
রোহিঙ্গা মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বছরের একেবারে শেষ ভাগে এসে মিয়ানমারে বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যা ছিল ২০১৭ সালের অগাস্টে সঙ্কট শুরুর পর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তৃতীয় প্রস্তাব।
মিয়ানমারে বর্বরতা বন্ধে এবং বাস্তুভিটা ত্যাগে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিরাপদে নিজ বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তার জন্যে বিশ্ব সম্প্রদায়ে বাংলাদেশের লাগাতার তদ্বিরের প্রেক্ষাপটে এই প্রস্তাব যৌথভাবে উত্থাপন করেছিল ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এই প্রস্তাব পাসের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের সার্বিক সমর্থনের ব্যাপারটি ফের দৃশ্যমান হল বলে কূটনীতিকরা মনে করছেন। একই অধিবেশনে মিয়ানমার পরিস্থিতির বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া পরিচালনা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে অর্থ মঞ্জুরির সর্বসম্মত একটি সিদ্ধান্তও হয়।
আরও খবর