মালামাল খালাসের পর পানি না ছিটিয়েই চলে যায় ট্রাকগুলো। যাওয়ার সময় ট্রাকের গায়ে লেগে থাকা ধুলাবালি-ক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়, বাতাসে।
এজন্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের অবহেলা আর অজ্ঞতাকে দূষছেন সংশ্লিষ্টরা। চিকিৎসকরা বলছেন, এভাবে ছড়িয়ে পড়া ধুলা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশ ট্রাক-কভার্ডভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসেবে, ঢাকা আশপাশের এলাকায় প্রায় ২০ হাজার ট্রাক বালু,ইট,সিমেন্ট,নির্মাণ এলাকার মাটি,পাইলিংয়ের কাদা-মাটি, রেডিমিক্স কংক্রিট পরিবহন করে।
এসব ট্রাক গাবতলী, আমিনবাজার, মোহাম্মদপুর, বছিলা, আবদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, পাগলা, ডেমরা, সারুলিয়া, কাঁচপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বালু ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্মাণ সামগ্রীর স্তূপীকরণ, পরিবহন ও প্রক্রিয়াকরণের প্রতিটি ধাপে অব্যবস্থাপনার ফলে ধুলিকণা ছড়িয়ে বায়ু দূষণ করছে।
তিনি বলেন,“শীতকালে কুয়াশার একটা ঘন আবরণ বাতাসকে খুব একটা উপরে উঠতে দেয় না। একটা আবদ্ধ জায়গার মধ্যে ধুলিযুক্ত-বিষাক্ত কণাযুক্ত বাতাসটা ধোঁয়া এবং ধুলার একটা মিশ্রণ তৈরি করে। ফলে অনেক বাতাসটা অনেক ভারী হয়ে ওঠে।”
বাতাসে ভাসমান এই ধূলিকণার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাতাসের মাধ্যমে এসব ধুলিকণা শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করছে।
“এটা ফুসফুসের প্রদাহসহ যেকোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। যাদের আগে হাঁপানি ছিল তাদের হাঁপানি আরও বাড়ায়, ব্রংকাইটিস হতে পারে। এছাড়া চোখের সমস্যা, নাকের কিছু সমস্যাও হতে পারে এ ধুলার কারণে।”
শনিবার ও রোববার রাতে রাজধানীর গাবতলী, যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণ সামগ্রীবাহী ট্রাকের অবাধ চলাচল।
গাবতলীতে দেখা যায়, সিমেন্টবাহী একটি খালি ট্রাক গাবতলীর দিকে যাচ্ছে। ট্রাকের কেবিনে পড়ে থাকা সিমেন্টের গুঁড়া বাতাসে উড়ছে।
ওই ট্রাকের পেছনে আমিন বাজার ব্রিজ ঘাট এলাকায় গিয়ে কথা হয় চালক জাফর আহমেদের সঙ্গে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দ্য সিমেন্ট জয়েন্ট নামে প্রতিষ্ঠানের ট্রাকটি আমিন বাজার ব্রিজ ঘাট থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সিমেন্ট সরবরাহ করে। ব্রিজঘাট থেকে সিমেন্ট বোঝাই করে কমপক্ষে ১ হাজার ট্রিপ যায় রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়।
ট্রাক থেকে সিমেন্টের গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা সিমেন্টের বস্তায় ছোট ছোট অসংখ্য ছিদ্র থাকে। আর সিমেন্টের অতি ক্ষুদ্র কণা এসব ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসে। এছাড়া কোনো কারণে বস্তা ছিঁড়ে গেলেও অন্যান্য বস্তার সঙ্গে সিমেন্ট লেগে যায়। পড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।
“সিমেন্ট জাহাজে আসে। ওঠানো নামানের সময় অনেকবার নাড়াচাড়া হয়। শ্রমিকরা লোড-আনলোড করে। ফলে ছিদ্রগুলা আরও বড় হয়ে সিমেন্ট বাইর হয়। আবার বস্তা ফাইটা গেলে অন্য বস্তার লগে সিমেন্ট লাইগা থাকে।”
এ কারণে জানতে চাইলে নুরুন্নবী নামে একজন বালু ব্যবসায়ী বলেন, প্রত্যেকটা ট্রাকে ত্রিপল দেওয়া থাকলেও শ্রমিকরা তা ব্যবহার করে না।
“আমরা মালিকরা প্রতিটা গাড়িতে ত্রিপল কিনে দিছি। মাল লোড করার পরেই ত্রিপল দিতে হয়। দেখা যাচ্ছে লেবাররা গাফিলতি করে ত্রিপল দিয়া ঢাকে না।”
মীর হোসেন নামে একজন ট্রাক শ্রমিক বলেন, দিনে ঢাকনা দিলেও রাতে কড়াকাড়ি না থাকায় তা দেন না তারা।
“দিনের বেলায় গেলে ঢাইকা নেই। কিন্তু রাতের বেলা তেমন ঢাকি না। দিনের বেলা পুলিশ ধরে, তয় রাতের বেলায় ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া আর কোথাও পুলিশ ধরে না।”
গাবতলী থেকে বালু নিয়ে শ্যাওড়াপাড়াগামী একটি ট্রাক অনুসরণ করে দেখা যায়, ট্রাকের চাকা-বডির বিভিন্ন অংশে বালি আটকে আছে। এছাড়া বাড়তি বোঝাই করায় ঝাঁকুনিতে তা সড়কে পড়ছে।
এভাবে বালু পরিবহনের কারণ জানতে চাইলে চালক রাকিব দাবি করেন, সব সময় ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখেন তারা। ড্রাইভিং সিটের পেছনে একটি ত্রিপলও দেখান তিনি।
“আসলে সব সময় ত্রিপল দেই। কিন্তু আইজকা দেই নাই।”
গাবতলী এলাকায় ছোট ট্রাকের পাশাপাশি বালু বহন করে বড় বড় ডাম্প ট্রাকও। এসব ট্রাকেও ঢাকনা নেই।
মাজার রোড এলাকা হয়ে মেট্রোরেল প্রকল্পের বালু নিয়ে আগারগাঁও যাচ্ছিল একটি ট্রাক। নম্বরবিহীন ট্রাকের চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা সব সময় ত্রিপল দেই। তয় আজ কোনো কারণে দেই নাই।”
কাঁচপুর, ডেমরা, সারুলিয়া, শ্যামপুর ও পোস্তগোলা এলাকা থেকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে বিভিন্ন ট্রাক যাত্রাবাড়ী ও সায়েদাবাদ এলাকা হয়ে রাজধানীতে ঢোকে।
রোববার রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, দোলাইরপাড় এবং ডেমরা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শত শত ট্রাক কোনো ঢাকনা ছাড়াই মালমাল পরিবহন করছে।
রাতের ট্রাকগুলো বেপরোয়া চলাচল করে বলে সেগুলোর সামনে দাঁড়াতে সাহস করেন না ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও।
তাদের একজন বলেন, “এইসব ট্রাকের বেশিরভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ, কাগজপত্রই নেই। রাতের বেলা আমরা এসব ট্রাকের সামনে যাই না। রাতের বেলা এগুলো এমনভাবে চলাচল করে যে এদের থামার সিগন্যাল দিতেই ভয় লাগে। ভাই আগে জীবন।”
ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় সুলতানা কামাল সেতু ও সারুলিয়া এলাকা থেকে বালু বহনকারী কোনো ট্রাকেই ত্রিপল দিয়ে ঢাকনা দেওয়া নেই।
জানতে চাইলে সেখানকার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন আইন আসার পর তারা এখন এসব ট্রাক আটকাচ্ছেন না।
“নতুন আইনে কী ধারা আছে, সেটা দেখতে হবে। এছাড়া নতুন আইনে মামলার করার জন্য যে রিসিট তা এখনও পৌঁছায়নি। এ কারণে মামলা দেওয়া আপাতত বন্ধ আছে। কিন্তু এখান থেকে যত ট্রাক চলে বেশিরভাগই ত্রিপল দেওয়া থাকে।”
বালু ছড়াচ্ছে নির্মাণ এলাকা
রাজধানীতে নির্মাণ এলাকার অপসারণকৃত মাটি ও পাইলিংয়ের কাদামাটি বহনকারী ট্রাক থেকেও অনেক কাদা চুইয়ে সড়কে পড়ে। এছাড়া নির্মাণ এলাকা ছেড়ে যাওয়ার সময় যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা মাটি লেপ্টে সড়কের অনেকদূর পর্যন্ত যায়।
এসব কাদা ও মাটি যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে সড়কে লেপ্টে থাকে। শুকিয়ে ধুলা তৈরি করে।
মিরপুরের বাউনিয়া এলাকার একটি নিচু জমিতে পাইলিংয়ের কাদামাটি ফেলে যাচ্ছিল একটি ট্রাক। চলে যাওয়ার সময় কাদার ট্যাংকি থেকে চুঁইয়ে তরল কাদা পড়ছিল সড়কে।
ওই ট্রাকের চালক জানান, বারিধারা এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাড়ির পাইলিংয়ের কাদামাটি এনে ফেলেছেন। কাদা সড়কে পড়ার বিষয়টি তিনি জানেন না।
“এ রকম হওয়ার সুযোগ কম। তবে কোনো কারণে লিক থাকলে পড়তেও পারে।”
গুলশানের ১৩৬ নম্বর সড়কের একটি বাড়ির ভুগর্ভস্থ তলা নির্মাণের জন্য মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সকালে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের অনেক দূর পর্যন্ত মাটি লেগে আছে।
মিরপুরে বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্মাণ এলাকার মাটি অপসারণের কাজে নিয়োজিত একটি ট্রাকের চালক আবদুল হাই বলেন, ঠিকাদারদের অবহেলায় সড়কে মাটি চলে আসে। ঠিকমতো ব্যবস্থা নিলে এটা রোধ করা সম্ভব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সবাই আইন জানে কিন্তু মানে না।
“যারা মালিক, কন্ট্রাক্টর তারা যদি গোড়ার দিকে সিস্টেম কইরা দেয় তাহলে আর ঝামেলা থাকে না। গুলশান-বনানী এলাকায় এ রকম মাটি সরানোর সময় কিছু কিছু রাস্তায় কার্পেট বা চট বিছাইয়া দেয়। মাটিগুলা কার্পেটে লাইগা যায়। কিন্তু অন্য এলাকায় তা করে না।”
কী ব্যবস্থা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ
বাংলাদেশ ট্রাক-কভার্ডভ্যান ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রুস্তম আলী খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলেন, এসব ট্রাক থেকে যে সড়কে ধুলাবালি ছড়িয়ে পড়ছে সেটি তিনিও জানেন। এ কারণে সম্প্রতি এসব বন্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তারা।
“এসব মালামাল পরিবহন তো আর বন্ধ করা যাবে না। তবে এসব যাবে পরিবেশ দূষিত না করে সেদিকে আমরা নজর রাখব। এর আগেও বিভিন্ন সময় আমরা বলেছি। আবার বলব।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ট্রাফিক) বাসুদেব বনিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাতের এসব ট্রাক যে পরিবেশ দূষণ করছে সে ব্যাপারে তিনিও একমত।
“আমরা এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিচ্ছি, তা আমাকে দেখে বলতে হবে। নতুন সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে। এ আইনটি আমরা একটু দেখেশুনে প্রয়োগ করছি।”
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক রুবিনা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ ধরনের ট্রাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পরিবেশ আইনে বলা নেই। তবে সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন নির্মাণ এলাকায় দূষণের দায়ে অভিযান চালাচ্ছেন তারা।
“আমরা যেখানে সেখানে নির্মাণসামগ্রী রাখা, রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রাখায় ধুলাবালি ওড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। এ বিষয়টি আমাদের মোবাইল কোর্টের আওতায় সেটা নাই।”