পাশাপাশি এখনও ঘাপটি মেরে থাকা একাত্তরের ঘাতক ও তাদের দোসরদের চেহারা উন্মোচনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। দাবি করেছেন একাত্তরের নিকৃষ্টতম হত্যাকাণ্ডে জড়িত রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের বিচার শেষ করার মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের দায়মোচনের।
দীর্ঘ নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির বিজয় যখন আসন্ন, তখনই ঘটে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম সেই হত্যাকাণ্ড। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে।
শরীরে নিষ্ঠুর নির্যাতনের চিহ্নসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের লাশ পাওয়া যায় মিরপুর ও রায়েরবাজার এলাকায়। পরে তা বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
শহীদ চিকিৎসক আব্দুল আলীম চৌধুরীর মেয়ে নুজহাত চৌধুরী বলেন, “আমাদের মায়েরা চলে যাচ্ছেন, সাক্ষীরা চলে যাচ্ছেন। তাই বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা দরকার।”
তাদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করেন বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান: “আমাদের বুদ্ধিজীবীরা যে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের পূর্ণ তালিকা আমরা করতে পারি নাই। তারা যে আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে তুলে ধরেছিলেন, তা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি নাই।”
একাত্তরের ঘাতকদের দোসররাও এখনও তৎপর মন্তব্য করে তাদের রুখে দিতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা।
বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে সংগ্রাম পত্রিকায় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ অভিধা দেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা জহিরউদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুদ্ধিজীবী দিবসের প্রাক্কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার প্রেতাত্মারা এটাকে গণহত্যা বলে মেনে নিচ্ছে না।
মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব হারুন হাবীব বলেন, “৪৮ বছরে এসে যখন বিজয় উদযাপন করছি, তখন দেখছি সে পরীক্ষিত শত্রুরা, একাত্তরের ঘাতকেরা আজও তৎপর। আমরা যারা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা তারা তো এ ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারি না।”
তিনি বলেন, “আমরা যে উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে গেলাম, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার উল্টো পথে যাত্রা করল দেশ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কাজটি সেখান থেকে শুরু হয়েছে। আমরা রুখতে পারিনি। এটা ছিল আমাদের ব্যর্থতা।”
মুক্তিযোদ্ধা ম হামিদ বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা আমাদের দায়বদ্ধতা। মঈনুদ্দীন ও আশরাফের মতো যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে আগামী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতা মোচনের প্রয়াসের মধ্যে আছি।”
মুক্তিযোদ্ধা তোতা মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকা নিয়ে।
“সরকারের উচিৎ, যারা আসলেই মুক্তিযুদ্ধ করছে তাদের দিকে নজর দেওয়া।”
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “একাত্তরের প্রেতাত্মা, সাম্প্রদায়িক নব অপশক্তি আজও এরা বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। বিষবৃক্ষের মূল উৎপাটন করাটাই হচ্ছে আজকে আমাদের অঙ্গীকার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদেরকে প্রতিহত করব, পরাজিত করব। আজকের এই দিনে এটাই আমাদের অঙ্গীকার।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই সরকার বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ণ করবে। সেই সঙ্গে যেসব যুদ্ধাপরাধী এখনও বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে ওই সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া আরও জোরদার করা হবে।
ওই নাটকে অভিনয় করা চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ফরিদা ইয়াসমীন আঁখি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর হতে চলেছে। খুব বেশি মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে নেই, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলবে। তবে যারা এখনও বেঁচে আছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য তাদের কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস জানার জন্য আমাদের সংস্কৃতি চর্চাও ব্যাপকভাবে করতে হবে।”
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেখানকার ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচারের দাবিও জানান এই তরুণ সংস্কৃতিকর্মী।
চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী জয় কুমার দাস রায়েরবাজারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে বলেন, “১৪ ডিসেম্বরের ইতিহাস নিয়ে আমাদের তরুণদের অনেকেই জানেন না। তাই ইতিহাস পাঠ ও চর্চা আরও বাড়াতে হবে। এভাবেই আমাদের ইতিহাস বয়ে যাবে অন্য প্রজন্মে।”