ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায় বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসও জানিয়ে গেছেন জাতিকে। একাত্তরের এই মুক্তিযোদ্ধা সব সময় অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়ের লড়াইয়ে ছিলেন সামনের কাতারে।
মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনে তার জীবন, চিন্তা-চেতনা ও কর্মের নানা দিক স্মরণ করেন লেখক, অধ্যাপক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা।
সেখানে বাবার দেশপ্রেম বোঝাতে পুরনো দিনের কথা স্মরণ করেন অজয় রায়ের ছোট ছেলে অনুজিৎ রায়।
“তিনি বলতেন, ‘এটা আমার দেশ। আমি এই দেশ ছেড়ে কেন যাব?”
অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও উদারতার বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন অজয় রায় দেখতেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সবাইকে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান অনুজিৎ রায়।
তিনি বলেন, “ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল চর্চা, উদার গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন আমার বাবা। এই বাংলাদেশ গড়তে পারলেই তার স্বপ্ন সার্থক হবে।”
ভাই অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে পারলে তার বাবা ‘কিছুটা স্বস্তিবোধ করতেন’ বলে মন্তব্য করেন অনুজিৎ।
অজয় রায়ের মতোই মৌলবাদের থাবায় ছেলে ফয়সাল আরেফিন দীপনকে হারিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক।
অজয় রায়ের কফিনে শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি বলেন, “তিনি বিচার চেয়ে মামলা করেছিলেন, বিচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটল। তার মাঝখানে চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। মামলার কী রায় হয়, তা আমরা দেখব। মামলা সঠিকভাবে সম্পন্ন হোক, যথার্থ অপরাধীরা শাস্তি পাক।”
অজয় রায় ‘মার্কসবাসী’ ছিলেন জানিয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, “তিনি মার্কসবাদী বলে নিজেকে পরিচয় দিতেন। তার চিন্তার মধ্যে মার্কসবাদী বৈশিষ্ট্য আছে। তবে তিনি কোনো কমিউনিস্ট গ্রুপ বা পার্টির সদস্য হয়ে তিনি কাজ করেননি। এই যে এত ভাগাভাগি, তিনি মর্মাহত ছিলেন।
“শোষণ, পীড়ন ও প্রতারণামুক্ত জনজীবন হোক- এই আকাঙ্ক্ষা ও চেষ্টা তার শেষ পর্যন্ত ছিল।”
রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য তিনি বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে কাজ করেছেন বলে জানান অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক।
অজয় রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “অজয় রায় মুক্তচিন্তার জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন। মুক্তচিন্তার কথা বলার মতো মানুষ আমাদের আশপাশে নেই। সেদিক থেকে আমরা অভিভাবকশূন্য।
“তার মৃত্যুতে মানবাধিকার আন্দোলন, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াই ও মানবতার সংগ্রামের নেতৃত্বে বিরাট শূন্যতা তৈরি হল।”
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “তিনি অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক লোক ছিলেন, যিনি বাংলাদেশের চেতনায় সার্বিকভাবে বিশ্বাস করতেন।”
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, “ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার জন্য যে সমস্ত উপাত্ত ও প্রকরণ দরকার তার সঙ্গে নিজেকে তিনি সংযুক্ত রেখেচিলেন আমৃত্যু।”
নতুন প্রজন্মের প্রতি এই ‘মাইলফলক ব্যক্তিত্বকে’ অনুসরণের পরামর্শ দেন তিনি।
জাতীয় জাদুঘরের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, “বিশ্বমানের এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক ছিলেন তিনি। ছিলেন জ্যোতিপদার্থ বিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদ। বাংলা সন চালু হয়েছে, তার ইতিহাস রচনায় তার ভূমিকা ছিল সর্বপ্রধান।”
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “চিন্তার জগৎ যখন ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, তখন তার বিরুদ্ধে যে কজন মানুষ সাহস দেখিয়েছেন, তার মধ্যে তিনি অন্যতম। আমরা তার দর্শনকে সঠিকভাবে নিজেদের জীবনে কাজে লাগাব।”
পরে অধ্যাপক অজয় রায়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়া তার কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জগন্নাথ হল ঘুরে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় বারডেমে।
অধ্যাপক অজয় রায়ের শেষ ইচ্ছানুযায়ী, তার মরদেহ দান করা হয়েছে বারডেমে। সেখানে ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মুহাম্মদ আবু তাহের খান তার মরদেহ বুঝে নেন।