এ লাইনটি লেখা হয়েছিল গ্রাফিক নভেল মুজিব-এর সপ্তম পর্বের খসড়ায়। সেই খসড়া যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাছে গেল, পাল্টে গেল ভাব আর ভাষা।
লাল কালিতে বাক্যটি কেটে প্রধানমন্ত্রী লিখলেন- “১৯৪৩ সালে দিল্লি থেকে তাজমহল না দেখেই ফিরতে হয়েছিল। এবার আর সেই ভুল করা যায় না জেনে আগ্রা গেলাম, হোটেল থেকে।”
এই পৃষ্ঠার শেষের বাক্য ছিল- “চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসল আর তার সাথে সাথে আমরা কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।”
পুরো বাক্যটি কেটে দিয়ে সেই জায়গায় প্রধানমন্ত্রী লিখছেন- “আমরা কলকাতা এলাম ফিরে।”
গ্রাফিক নভেল মুজিব প্রকাশের শুরু থেকেই এভাবে সম্পাদনা করে, নাম ঠিক করে দিয়ে এবং বিভিন্ন নির্দেশনাসহ নানা পরামর্শ দিয়ে আসছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রাফিক নভেল হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম। ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ গ্রাফিক নভেল মুজিবের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ প্রকাশ করে আসছে।
সিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের বই করার ধারণা প্রথমে দেন রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়। বইটির নাম প্রধানমন্ত্রীই ঠিক করে দেন।”
সিআরআইয়ের ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক সম্প্রতি ফেসবুকে জানান, শিগগিরই বাজারে আসছে গ্রাফিক নভেল মুজিব-এর সপ্তম পর্ব।
খালা শেখ হাসিনার নিজের হাতের সম্পাদনার কিছু ছবি শেয়ার করে রাদওয়ান ওই ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “তার সুচারু ইতিহাস বোধের কারণে ধরা পড়ে সকল সূক্ষ্ম ভুলভ্রান্তি ও বিচ্যুতি।”
সাব্বির বিন শামস বলেন, অনেক জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ছবি কেমন হবে সেটা প্রধানমন্ত্রী দেখে দেন।
“গল্পগুলো বাছাই করে সংলাপগুলো বসানোর পরে- কোন শব্দটা আসলে ব্যবহার করা উচিৎ, ছবিতে কী ধরনের পোশাক হবে, দুজনের মধ্যে যেসব সংলাপ আছে, সেগুলো যথার্থ কি না- সবই দেখে দেন প্রধানমন্ত্রী। বানান, ছবি, গল্প বলার ধরন- সবই তিনি দেখে দেন।”
প্রধানমন্ত্রী কতটা খুঁটিনাটি খেয়াল রাখেন, সেই বর্ণনায় সাব্বির বলেন, “এক জায়গা দেখে বললেন, ‘আমার দাদার দাড়ি যে পরিমাণ লম্বা ছিল সেটা তোমরা আনতে পারোনি।”
গ্রাফিক নভেল মুজিব-৭ এর এর জন্য ছবি আঁকা, সংলাপ বসানো ও সম্পাদনার কাজ হচ্ছে তিনটি স্তরে।
সাব্বির বলেন, “গল্পগুলো অনেক আগেই পাঠানো হয়েছিল। একেকটা খণ্ডের জন্য আমরা খসড়া দিই। ছবি এঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর উনার (প্রধানমন্ত্রী) মতামত নিয়ে ঠিকঠাক করে আবার পাঠানো হয়। ফাইনালি উনি দেখে দেওয়ার পর আমরা প্রকাশের ব্যবস্থা করি।”
সাব্বির বিন শামস বলেন, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনে নতুন কী করা যায় সেই ভাবনা থেকেই গ্রাফিক নভেলের ধারণাটি মাথায় আসে।
“ইয়ংবাংলার ছেলেমেয়েরাও চাইছিল তাদের কিছু থাকা উচিৎ। দেশের বাইরেও গ্রাফিক নভেল হচ্ছে। গান্ধীর ওপরও হয়েছে। এটা প্রথম মাথায় আসে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের।”
গ্রাফিক নভেল যেহেতু জনপ্রিয় একটি মাধ্যম, সেহেতু এ মাধ্যম ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুকে তরুণদের কাছে নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরাই এ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য ছিল বলে জানান সাব্বির।
এর সম্পাদক শিবু শীল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা ববি ভাইয়ের আইডিয়া। বঙ্গবন্ধু এত বড় একজন নেতা। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। বড় নেতাদের নিয়ে সারাবিশ্বেই গ্রাফিক নভেল হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ সংস্কৃতি ছিল না। গ্রাফিক নভেলের মাধ্যমে গল্প বলা পপুলার, মডার্ন একটা অ্যাপ্রোচ।”
তবে একটি আত্মজৈবনিক রচনাকে ফিকশনের রূপ দেওয়া সহজ ছিল না বলে জানালেন শিবু।
“অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধুকে আমরা দেখিনি। তার ওপর এদেশে দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। আমরা অসমাপ্ত আত্মজীবনীকে ভিত্তি ধরে কাজ করেছি। সেই বইটি ভিত্তি ধরে শিল্পীর চোখে যতটুকু করা যায়।”
শিবু বলেন, গ্রাফিক নভেল মুজিবের প্লটে ভাসানী বা সোহরাওয়ার্দীর অনেক চরিত্র আছে, যাদের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিলেই জানা যায়। কিন্তু এমন অনেক চরিত্র আছে যাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য নেই।
“ফলে তারা দেখতে কেমন ছিলেন, কেমন পোশাক পড়তেন- এসব বিষয়ে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। সংলাপগুলো আমাদের করতে হয়েছে।”
“যেমন, একটা জায়গায় ইঞ্জিনের ওপর পোস্টার লাগানো গ্রাফিক করা হয়েছিল। উনি বললেন, ইঞ্জিনে তো পোস্টার লাগায় না। ওটা বগিতে লাগাও।
“ভাষার ঐক্য, ছবি, সবকিছুই উনি যত্ন করে সময় নিয়ে দেখে দিচ্ছেন শত ব্যস্ততার মধ্যেও। আমাদের সব সময় নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সবসময় তিনি সম্পাদকীয় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।”
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশের সময়ও সম্পাদনার কাজে অনেক সময় ও শ্রম দিয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনার নিজের লেখা বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তার বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশ বিভাগের পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে।
এছাড়া আছে বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সর্বংসহা সহধর্মিনীর কথা, যিনি তার রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে পাশে ছিলেন অবিচল।
প্রথম পর্বে খেলাধুলা, পড়াশোনা, ডাক্তারের কাছ থেকে পালানো, প্রথমবারের মতো কারাবরণের মত ঘটনার পাশাপাশি দেশের প্রতি কিশোর শেখ মুজিবের দায়িত্ববোধ আকৃতি পেতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় পর্বে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ির পাশাপাশি তার প্রেরণা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি উঠে আসে।
তৃতীয় পর্বে বঙ্গবন্ধুর স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষের সময় তার মানবিক ভূমিকার বিষয়গুলো এসেছে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন শেষে তরুণ শেখ মুজিবের দিল্লির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও ১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে তার ভূমিকার বিষয়টি এসেছে চতুর্থ পর্বে।
অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার পরও ১৯৪৫ সালে শেখ মুজিবকে কীভাবে মুসলিম লীগের ছাত্রসংগঠনের পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে তাকে নাড়া দিয়েছিল,তা পঞ্চম পর্বে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
আর সিরিজের ষষ্ঠ পর্বে তুলে ধরা হয়েছে খাজা নাজিমুদ্দিনের নানা কূটকৌশলে বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান।