যুদ্ধাপরাধ: রাজশাহীর টিপু সুলতানের রায় বুধবার

রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাবেক শিবির নেতা মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় জানা যাবে বুধবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2019, 05:13 AM
Updated : 10 Dec 2019, 05:16 AM

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতন, লুটতরাজ, হত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে এ আসামির বিরুদ্ধে।

মঙ্গলবার বিচারপতি শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি বুধবার রায়ের জন্য রাখে।

প্রসিকিউশন ও আসমি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৭ অক্টোবর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিল ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের পক্ষে এ মামলায় শুনানি করেন মো. মোখলেসুর রহমান বাদল ও জাহিদ ইমাম। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।

প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল মনে করেন সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তারা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এ কারণে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চাওয়া হয়েছে শুনানিতে।   

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজশাহীর বোয়ালীয়ায় দশ জনকে হত্যা, দুই জনকে দীর্ঘ দিন আটকে রেখে নির্যাতন, ১২ থেকে ১৩টি বাড়ির মালামাল লুট করে আগুন দেওয়ার অপরাধ উঠে এসেছে তদন্তে। এসব অপরাধে আসামির বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ গঠন করা হয়।”

“প্রসিকিউশনের পক্ষে মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন, যাদের মধ্যে একজন ভিকটিমও আছেন। আমরা যথাযথভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে তুলে ধরে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছি।”

অন্যদিকে সামির পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ হল- ভিকটিমদের ধরে নেওয়ার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
 
“তারপর ভিকটিমরা কোথায় গেল, তাদের কী হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সাক্ষী আনতে পারেনি প্রসিকিউশন। যারা হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় না এনে এই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে শুধুমাত্র স্থানীয় ও রাজনৈতিক বৈরীতার কারণে। এ কারণে আমি আমার মক্কেলের খালাস চেয়েছি।”

কে এই টিপু সুলতান

নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া টিপু সুলতানকে একত্তরের ভূমিকার জন্য রাজশাহীর অনেকে চেনে ‘টিপু রাজাকার’ নামে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বলছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্থানীয় যে রাজাকাররা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে টিপু সুলতানই বেঁচে আছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় টিপু ছিলেন জামায়াতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের স্থানীয় কর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই ছাত্রসংঘ নাম বদলে হয় ইসলামী ছাত্রশিবির। টিপু শিবিরের রাজনীতিতেও যুক্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার অভিযোগপত্রে।

সেখানে বলা হয়, ১৯৮৪ সালের পর টিপুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার আর তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে লেখাপড়া করা টিপু সুলতান ১৯৮৪ সালে নাটোরের গোপালপুর ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। ২০১১ সালে সেখান থেকেই তিনি অবসরে যান।

১৯৭৪ সালের ১০ অগাস্ট টিপু সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের এক মামলায় মতিহার থানার পুলিশ তাকে ফের গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

মামলা বৃত্তান্ত

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৭ সালের ২ মে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের তদন্ত শুরু বরে। তদন্ত শেষে গতবছর ২৭ মার্চ ছাত্রশিবিরের এই সাবেক নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় প্রসিকিউশনের তদন্ত দল।

গত বছর ২৯ মে প্রসিকিউশনের দেওয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়ে ৮ অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে টিপু সুলতানের বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন এ মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। এছাড়া রাজশাহী জেলার রাজাকার তালিকা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা এবং ১৯৭১ সালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনও জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে তুলে ধরা হয়।

অভিযোগ-১: একাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুর দেড়টা থেকে পরদিন মধ্যরাত পর্যন্ত আসামি মো. আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু সুলতান ওরফে টিপু রাজাকার স্থানীয় অন্যান্য রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা বোয়ালিয়া থানার সাহেব বাজারের এক নম্বর গদিতে (বর্তমানে জিরো পয়েন্ট) হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বাবর মণ্ডলকে আটক করে।

তাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে দিনভর নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।

অভিযোগ-২: একাত্তরের ২ নভেম্বর রাত আনুমানিক ২টায় আসামি টিপু সুলতান, স্থানীয় রাজাকার এবং ৪০ থেকে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা বোয়ালিয়া থানার তালাইমারী এলাকায় হামলা চালায়।

সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা চাঁদ মিয়া, আজহার আলী শেখসহ ১১ জনকে আটক করে নির্যাতন চালানো হয়। তালাইমারী এলাকার ১২ থেকে ১৩টি বাড়ি লুটপাটও চালানো হয়।

পরে আটক ১১ জনকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে বসানো অস্থায়ী ক্যাম্প ও টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৪ নভেম্বর মাঝরাতে নয় জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।  

সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বাকি দুই জনের মধ্যে একজন এখনও জীবিত আছেন। তিনিও এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন জানান।