কোন্দলে সৃষ্ট ‘নব্য জেএমবি’ যেভাবে গুলশান হামলায়

এক যুগ আগে শায়খ আবদুর রহমান, বাংলা ভাইসহ শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির পর নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গি তৎপরতা কিছুটা স্তিমিত হলেও ঘর গোছানোর কাজ কখনও থামায়নি সংগঠনটি।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2019, 07:10 PM
Updated : 26 Nov 2019, 07:25 PM

বরং তাদের বিদায়ের পর সংগঠনের ভেতরে দেখা দেওয়া কোন্দলের সুযোগে ‘নব্য জেএমবি’ নামের যে অংশটির আবির্ভাব ঘটে, সেটি আরও বেশি সংগঠিত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং আরও বেশি উগ্র মতাদর্শে পরিচালিত।

জেএমবির ‘অতি উগ্র’ এই অংশটির দ্বারাই তিন বছর আগে ঢাকার গুলশানে ঘটে যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনা।

ওই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) বাংলাদেশে নব্য জঙ্গিদের উত্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ডের তথ্য বের করে এনেছে।

গুলশান হামলার সেই রাত

মামলার অভিযোগপত্রে উঠে এসেছে, কীভাবে অন্তর্কোন্দলে জেএমবি থেকে নব্য জেএমবির জন্ম, গুলশান হামলা- তার বিবরণ।

মামলার তদন্তের সময় সারাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর বিভিন্ন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, বিভিন্ন সময়ে আটক জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের স্বীকারোক্তি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জেএমবি থেকে একটি ‘অতি উগ্র’ অংশের উত্থান ঘটে, যা ‘নব্য জেএমবি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই অংশটিই হলি আটিজান বেকারিতে হামলা চালায়।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের চোখে যারা ‘নব্য জেএমবি’ তারই র‌্যাবের ভাষায় জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম গ্রুপ’।

গুলশান হামলার উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা: অভিযোগপত্র

গুলশান হামলা: জঙ্গিদের গ্রেনেড প্রশিক্ষণ হয় বুড়িগঙ্গায়  

হলি আর্টিজান থেকে সেই রাতে যেভাবে ছবি পাঠিয়েছিল জঙ্গিরা

গুলশান হামলা: প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্ণনায় সেই রাত

আছাদুজ্জামান মিয়ার বয়ানে ওই রাতে পুলিশের ভূমিকা  

গুলশান হামলা: আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আশায় রাষ্ট্রপক্ষ  

২০০১ সালে শায়খ রহমানের নেতৃত্বে জন্ম জেএমবির। ২০০৪ সালের দিকে এতে যোগ দেন সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানিসহ অনেকে।

সেসময় রাজশাহীর বাগমারায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে নৃশংস কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ‘সর্বহারা নিধন’ শুরু হলে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় ২০০৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

বাংলাভাই ও শায়খ রহমান

গুলশান হামলা মামলা অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, নিষিদ্ধ ঘোষণার পরই জেএমবি মরিয়া হয়ে উঠে এবং ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয়।

সারাদেশে বোমার হামলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় শায়খ রহমান, বাংলা ভাই, আব্দুল আউয়াল, আতাউর রহমান সানিসহ অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে আবদুর রহমান ও বাংলা ভাইসহ ছয় শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

শীর্ষ নেতৃত্ব ছেঁটে ফেলার পর জেএমবি কিছুটা দুর্বল হলেও বন্ধ হয়নি সাংগঠনিক তৎপরতা। ওই সময় সংগঠনের দায়িত্ব নেন সাইদুর রহমান। ২০১০ সালে সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হলে ‘ডাক্তার’ নজরুল অঘোষিত নেতা হিসেবে সংগঠনের মূল দায়িত্ব পালন শুরু করে। কিন্তু নজরুলের নেতৃত্ব মেনে নিতে পারেননি জেলে থাকা সাইদুর।

ওই সময় বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকায় জেএমবির নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। স্পষ্ট হয়ে উঠে কারাগারে থাকা সাইদুর রহমান, সালাউদ্দিন সালেহীন এবং বাইরে থাকা নজরুল, সারোয়ার জাহান (আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত) পক্ষের বিরোধ। ২০১৩ সালের শেষে দিকে দিনাজপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় নজরুল নিহত হন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সাংগঠনিক কোন্দলের মধ্যে নিজের দল ভারী করতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরোয়ার জাহানের নির্দেশে ‘অ্যাডভোকেট’ ফারুকের (ফারুক হোসেন ওরফে জামাই ফারুক, যিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সেখানে তার নাম বলা হচ্ছে আনোয়ার হোসেন ফারুক) নেতৃত্বে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন, রাকিবুল হাসান (পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত) ও জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজানকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা।

কিন্তু দল বিভক্ত হওয়ার কারণে আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লে শুধু উত্তরাঞ্চলে জেএমবির তৎপরতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সরোয়ার জাহান এবং তার সহযোগী মামুনুর রশিদ রিপন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করে এবং তারই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাজক, পুরোহিত, মাজারের খাদেম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করতে শুরু করে বলে হলি আর্টিজান মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

ওই সময়ই আবির্ভাব ঘটে তামিম আহমেদ চৌধুরীর (২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে অভিযানে নিহত)। কানাডার পাসপোর্টধারী তামিম ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে পুলিশের ভাষ্য।

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের মে মাসের দিকে তামিমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেএমবির একাংশের নেতৃত্ব দেওয়া সরোয়ার জাহান, মামুনুর রশীদ রিপন ও অন্যরা একত্রিত হয়ে ‘আইএসের ভাবধারায় জিহাদ’ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

তারা আইএস ভাবধারার অডিও-ভিডিও যশোর, বগুড়া, গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর পাশাপাশি সদস্য সংগ্রহ শুরু করে। সদস্য হিসেবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র, মসজিদের ইমাম, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী, অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের যুবক, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া তরুণ এবং সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেছে নেওয়া হয়।

গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জবানবন্দি এবং বিভিন্ন অভিযানে পাওয়া আলামতের ভিত্তিতে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তামিম চৌধুরী উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় কথিত জিহাদের অপব্যাখ্যা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন ও হৃদয়স্পর্শী নথিপত্রের ‘ডকুমেন্ট’ তৈরি করে সদস্যদের কাছে সরবরাহ করতেন, যাতে তারা সহজে আকৃষ্ট হন। নতুন সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ফোনে কথা না বলে বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করতেন।

তামিম চৌধুরী

তামিম ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের ভেতরে-বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল অর্থও সংগ্রহ করেছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। আর এই অর্থ জোগাতে খিলগাঁওয়ের চিকিৎসক খন্দকার রোকনউদ্দিনের কথাও আসে তদন্তে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, প্রথম ধাপে সংগ্রহ করা কিছু সদস্যকে ঢাকার মিরপুরের কয়েকটি ভাড়া বাসায় রেখে একমাস ধরে জঙ্গি কোরান-হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এসব আস্তানায় জঙ্গি নেতা নূরুল ইসলাম মারজান (মোহাম্মদপুরে ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত), রাকিবুল ইসলাম রিগান (বর্তমানে কারাগারে আটক) প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। মিরপুরের এমনই একটি বাসায় হলি আটিজানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগপত্রে এসেছে।

তামিম-সারোয়ারের নেতৃত্বেই পরে প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের নিয়ে গঠন করা ‘নব্য জেএমবি’। বাছাই করা জঙ্গিদের দিয়ে বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সংগঠনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে থাকেন নূরুল ইসলাম ওরফে মারজান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী (বর্তমানে কারাগারে), শরিফুল ইসলাম খালেদ, তানভীর কাদেরী (আজিমপুর অভিযানে নিহত), অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম (রূপনগর অভিযানে নিহত), মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিযানে বাসারুজ্জামান চকলেটের সঙ্গে নিহত), রায়হানুল কবির রায়হান, আসলাম হোসেন সরদার র‌্যাশ (বর্তমানে কারাগারে) ও অন্যরা।

জাহিদুল ইসলাম, তানভীর কাদেরী ও খন্দকার রোকনুদ্দীন

নতুন সদস্যদের এক মাস আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে ‘স্মল সেল টেরোরিজম’ ধারণার আলোকে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা হয়।

তারই অংশ হিসেবে বিদেশি পর্যটক, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, মন্দিরের পুরোহিত, খ্রিস্টান পাদ্রী, লেখক, তৈরি পোশাকের ক্রেতা ও অন্য ধর্মের উপাসনালয়কে ‘কৌশলগত শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে ৫-৭ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত দলকে লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় নিয়োজিত করা হয়।

এভাবে ছোট ছোট হামলার দেশে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার পর বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নব্য জেএমবি তাদের প্রথম বড় অভিযানের লক্ষ্য হিসেবে হলি আটিজান বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। কারণ রেস্তোরাঁটি ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।

গুলশান হামলাকারী পাঁচ তরুণ

এরপরই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তামিম-সারোয়ারের সরাসরি সার্বিক তত্ত্বাবধানে ঘটানো হয় চূড়ান্ত হামলা। যে হামলা বাংলাদেশের দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে দেয়।  বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক বিস্তারের মাত্রাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ওই হামলার মাধ্যমে।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, নব্য জেএমবির ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।