আছাদুজ্জামান মিয়ার বয়ানে ওই রাতে পুলিশের ভূমিকা

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার খবর পেয়ে ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে ছুটে যান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, এরপর অভিযান চালাতে গিয়ে গ্রেনেডে দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু, গোলাগুলি ও পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযান- রুদ্ধশ্বাস সেই রাতে আরও যেসব ঘটনা ঘটেছিল তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

রুদ্র রুদ্রাক্ষবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2019, 06:01 PM
Updated : 26 Nov 2019, 06:12 PM

বর্তমানে জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়া সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সেই হামলা মামলার রায়ের আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, রোজার ঈদের কয়েক দিন আগের সেই ঘটনাকে প্রথমে ছিনতাই ভাবলেও ’গোলাগুলির’ ঘটনা তাদের চোখ খুলে দেয়।

”প্রথমে ভেবেছিলাম ছিনতাইয়ের ঘটনা হবে। কিন্তু পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে গোলাগুলির ঘটনা এবং বিদেশিদের অবস্থান সব মিলিয়ে বুঝতে পারি ঘটনাটা জঙ্গি হামলা। প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় লেগেছিল এটা বুঝে উঠতে।”

জঙ্গি হামলার পর কমান্ডো অভিযান চালিয়ে মুক্ত করা হয় হলি আর্টিজান বেকারি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে হয়েছিল ভয়াবহ ওই হামলা; হামলাকারীরা ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিদের রুখতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

বুধবার দুপুরে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণার কথা রয়েছে। তার আগে এক সাক্ষাৎকারে হামলার দিনের ঘটনাক্রমের সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন আছাদুজ্জামান মিয়া।

যা ঘটেছিল সেদিন

হামলার দিন ইফতার সেরে বাসায় ফেরার পথে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার মোশতাক আহমেদের কাছ থেকে ঘটনার খবর পান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার।

”ফোনে শুধু বলল, হলি আর্টিজানে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, আমি ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। বিস্তারিত কিছুই জানি না। আমিও তখন সাথে সাথে গাড়ি ঘুরিয়ে ঘটনাস্থলে চলে আসি ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যে। গিয়ে দেখি প্রায় একশ’ জনের মতো ফোর্স সেখানে রয়েছে,” বলেন আছাদুজ্জামান মিয়া।

ঘটনাস্থলে গিয়ে ‘চরম উত্তেজনাকর’ পরিস্থিতি দেখার পাশাপাশি সহকর্মী উপ-পরিদর্শক ফারুকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা স্মরণ করে তিনি।

”ওখানে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, আমাদের সাব ইন্সপেক্টর ফারুক। সন্ত্রাসীদের ব্যাপক গোলাগুলির প্রেক্ষিতে আমাদের পক্ষ থেকেও পাল্টা গুলি ছোড়া হয়। এক পর্যায়ে হলি আর্টিজানের খোলা মাঠ থেকে সন্ত্রাসীরা ভেতরে চলে যায়।”

একজন ভিকটিমের সাবেক সেনাসদস্য দেহরক্ষীর কাছ থেকেও ঘটনার একটি বিবরণ শোনার কথা জানান আছাদুজ্জামান মিয়া।

”ফোনে তিনি জানিয়েছেন, ‘বাইরে ড্রেনের পাশে দুজন বিদেশিসহ আমরা বেশ কয়েকজন আটকা পড়ে আছি, আমাদের বাঁচান’। আমাকে ডিসি গুলশান এই কথা জানানোর সাথে সাথেই কাউন্টার ফায়ারের সিদ্ধান্ত নেই।”

জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকতে গিয়ে বোমা আর গুলির মধ্যে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান।

এডিসি ওবায়েদের মাধ্যমে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পাওয়ার পর নিজেও অভিযানে যোগ দেওয়ার কথা জানান তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার।

”এরপর গুলি করতে করতে ভেতরে ঢুকে যাই আমরা। ঘটনাস্থল থেকে নয়জনকে জীবিত উদ্ধার করে বের করে আনি।”

এরপর হলি আর্টিজানের গেইট পেরিয়ে ৮৪ নম্বর সড়কের মাথায় চলে আসার পর সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় বলে জানান আছাদুজ্জামান মিয়া।

“আমার ১০ গজ পেছনে আমাদের অনেক সদস্য রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তৎকালীন বনানী থানার ওসি, তরুণ এসি রবিউলসহ আহতদের ইউনাইটেড হসপিটালে পাঠাই। দুঃখজনকভাবে এরপর হসপিটাল থেকে সালাউদ্দিন ও রবিউলের মৃত্যুর খবর আসে,” এভাবে চোখের সামনে সহকর্মীদের হারানোর বর্ণনা দেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার।

আঘাতের পর পাল্টা প্রতিরোধে

জঙ্গিদের আক্রমণের মুখে পড়ার পর টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরিস্থিতি জানানোর কথা উল্লেখ করেন আছাদুজ্জামান মিয়া।

”তিনি আমাকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে যেতে বলেন। তিনি বলেছিলেন, কোনো পুলিশ সদস্য এবং ভেতরে আটকে থাকা একজনেরও যেন মৃত্যু না হয় সেভাবে ব্যাবস্থা নিতে।”

এরপর পাশের বড় ভবনগুলোতে অবস্থান নিয়ে ’কাউন্টার ফায়ারে’ যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ”যেন সন্ত্রাসীরা বেরিয়ে যেতে না পারে। ইতোমধ্যে অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও ঘটনাস্থলে যোগ দেয়।”

গুলশানের ৮৪ নম্বর সড়কের মাথায় অস্থায়ী কন্ট্রোল রুম খুলে অভিযান পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “সারা রাত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের পর সেহেরির সময় সেনা, নৌ, বিমান, বিজিবিসহ সব বাহিনীর প্রধান গণভবনে চলে যাই। আলোচনা শেষে সেনাবাহিনীকে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রী।

“ভোরের আলো ফোটার আগেই যেন অপারেশন থান্ডারবোল্ট হয়, সেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল,” বলেন তিনি।

ওই অপারেশনের পর ঘটনাস্থল থেকে নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গুলিতে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। এই অভিযানের মধ্যে ক্রসফায়ারে পড়ে নিহত হয়েছিলেন হলি আর্টিজানের পাচক সাইফুল ইসলাম।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার আগাম গোয়েন্দা তথ্যের বিষয়ে এক প্রশ্নে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “সম্ভাব্য জঙ্গি হামলার তথ্য ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এ রকম একটা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে এ রকম ভয়াবহ জঘন্য হামলা হতে পারে- এ সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা আমাদের কাছে ছিল না।”

হলি আর্টিজানে হামলার পর ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে ছয় মাসের মধ্যে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় বলে দাবি করেন সাবেক ডিএমপি কমিশনার।

তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানের পরে অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আশঙ্কা করেছিল, বাংলাদেশ আর কখনও জঙ্গিবাদের থাবা থেকে বের হতে পারবে না। অনেক বিদেশি নাগরিক তাদের পরিবারও দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সবার আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করে আমরা মাত্র ছয় মাসের মধ্যে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছি।”

জঙ্গিবাদ নির্মূল সময়সাপেক্ষ হলেও সময়ের ধারাবাহিকতায় সেটি বিলীন হয়ে যাবে বলেই মনে করেন জাতীয় নিরাপত্তা সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান মিয়া।

তিনি বলেন, “এটা আসলে দুই-এক বছরে সম্ভব না। ভ্রান্ত আদর্শ পুরোপুরি মুছে দিতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সামাজিক সচেতনতা। সেই সচেতনতা তৈরির কাজ চলছে। অব্যাহত রয়েছে প্রশাসনিক তৎপরতাও।”