গুলশান হামলা: আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আশায় রাষ্ট্রপক্ষ

তিন বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলার মামলাটির রায় হবে বুধবার।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2019, 03:59 PM
Updated : 26 Nov 2019, 07:26 PM

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এই মামলায় আট আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা; যদিও এই আসামিদের সবাই আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করেছিলেন।

রায়ের আগের দিন মঙ্গলবার এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তা বিপন্ন করতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করা হয়। কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসীদের।

“তাই এই মামলার রায়ে অভিযুক্ত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হবে বলে আমরা আশাবাদী,” বলেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জাকির; যিনি দাবি করছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন তারা।

আসামিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে আইনে।

পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বসে বিচারক মো. মজিবুর রহমান আলোচিত এই মামলার রায় দেবেন।

এক বছর আগে বিচার শুরুর পর রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য শোনার পর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৭ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন এই বিচারক।

নব্য জেএমবির সদস্য আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার এই রায়কে কেন্দ্র করে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ইতোমধ্যে নিয়েছে র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জঙ্গি হামলার পর কমান্ডো অভিযান চালিয়ে মুক্ত করা হয় হলি আর্টিজান বেকারি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই চালানো ওই হামলার ঘটনা বড় শিরোনাম হয়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক সব সংবাদ মাধ্যমে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক বিস্তারের মাত্রা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ওই হামলার মাধ্যমে।

জঙ্গিবাদ যে সমাজের ধনী পরিবারের ছেলে, আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল, তাও উঠে আসে এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।   

সেদিন সশস্ত্র পাঁচ জঙ্গি ওই ক্যাফেতে ঢুকে প্রথমে সবাইকে জিম্মি করেছিল;  রাতে ১৭ বিদেশি ও তিনজন বাংলাদেশিকে গলাকেটে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

এরা এখন স্মৃতির পাতায়; গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তারা।

রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলাকারী পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়েন। অভিযানে হলি আর্টিজান বেকারির এক কর্মী নিহত এবং আরেকজন আহত হন। আহত ব্যক্তিও পরে মারা যান।

হামলার পরপরই মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তা ইন্টারনেটে এলেও বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।

গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে নব্য জেএমবির একের পর এক আস্তানার সন্ধান বেরিয়ে আসে; অভিযানে মারাও পড়েন শীর্ষনেতাদের অনেকে, যাদের এই হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এরপর গ্রেপ্তার আটজনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় সেই মামলায়, হামলার তিন দিন পর যা দায়ের করেছিলেন গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস।

হামলায় আহত গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল করিমকে সহকর্মীরা নিয়ে যান হাসপাতালে। ওই রাতেই মৃত্যু হয় তার।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির দুই বছর তদন্ত করে ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান। পরে বাকি দুজন গ্রেপ্তার হলে তারাও আসে বিচারের আওতায়। বিচার শুরুর এক বছর পর রায় হতে যাচ্ছে।

মামলার আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

হামলা : এক নজরে

হামলা: ১ জুলাই, ২০১৬ , রাত পৌনে ৯টা।

হামলাস্থল: গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হলি আর্টিজান বেকারি।

হামলাকারী: মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। (সবাই অভিযানে নিহত)।

হামলায় নিহত: বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় নিহত হন। নিহত বাংলাদেশিরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবীর।

নিহত পুলিশ কর্মকর্তা: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল করিম এবং বনানী থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান।

জীবিত উদ্ধার: ভোরে কমান্ডো অভিযান শেষে জীবিত উদ্ধার করা হয় নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে।

বিচার: এক নজরে

মামলা দায়ের: ২০১৬ সালের ৪ জুলাই, সন্ত্রাস দমন আইনে, গুলশান থানায়।

মামলাকারী: গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস।

তদন্তকারী: কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির।

জিজ্ঞাসাবাদ: জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি।

অভিযোগপত্র দাখিল: ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই। হামলায় জড়িত মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকেই কেবল আসামি করা হয়।

হামলায় জড়িত, অভিযানে নিহত: তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান।

স্বীকারোক্তি: ৬ আসামি দিয়েছেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। দেননি শরিফুল ও মামুনুর।

অভিযোগ গঠন: ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।

সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু: ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। প্রথম সাক্ষ্য দেন বাদী এসআই রিপন।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ: ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর।

রায়ের তারিখ ঘোষণা: ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর।

‘কলঙ্ক মোচন’র আশা

গুলশান হামলা বাংলাদেশের উপর যে কলঙ্কের ছাপ বসিয়ে দিয়েছিল, মামলার রায়ের মধ্য দিয়ে তা মুছবে বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার জাকির বলেন, “জঙ্গিরা বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন এবং বহির্বিশ্বের নিকট বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছিল। এখানে নিরীহ বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে, যাদের অনেকে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী।”

গুলশান হামলায় নিহত জাপানিরা ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে কাজ করতেন। এই জঙ্গি হামলার পর বিদেশি অনেকে বাংলাদেশে কাজ করতে শঙ্কিত বোধ করলে নানা প্রকল্পের গতি থমকে গিয়েছিল সাময়িক সময়ের জন্য।

গুলশান হামলার মামলার আসামিদের কয়েকজন।

তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সাক্ষ্যে বলেছিলেন, “হলি আর্টিজান বেকারি কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত থাকায় সেখানে হামলা করার পেছনে কারণ ছিল জঙ্গিদের নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া।

“এছাড়া বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটনানোর পাশাপাশি তারা এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চেয়েছিল।”

মামলার অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।

হামলাকারী পাঁচ তরুণ- নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল, মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ও শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জাকির বলেন, “আমি মনে করি, আমরা এই ঘটনায় আসামিদের দায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি। তাই আমরা আশাবাদী, অভিযুক্ত আসামিদের সবাই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে।”

এই রায়ের অন্য প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

“আমরা বিশ্বাস করি, আসামিদের বিচারের মাধ্যমে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ক্ষত কিছুটা হলেও মোচন হবে। এই রায়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতি একটা বিশেষ বার্তাও যাবে; সেটি হল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে কোনোভাবেই পার পাওয়া যায় না।”

“আশা করি, রায়ে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হবে, যাতে ভবিষ্যতে যুব সমাজের আর কেউ জঙ্গিবাদের মতো ভয়াবহ ও অভিশপ্ত পথে পা বাড়াবে না,” বলেন অ্যাডভোকেট জাকির।