গুলশান হামলা: জঙ্গিদের গ্রেনেড প্রশিক্ষণ হয় বুড়িগঙ্গায়

গুলশানের হলি আর্টিজান ক্যাফেতে হামলা চালানোর আগে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে জঙ্গিরা গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Nov 2019, 06:28 PM
Updated : 26 Nov 2019, 06:49 PM

এই মামলায় আদালতে দেওয়া পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ওই হামলার আগে ঢাকার লেডিস ক্লাবসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নজরদারি চালান জঙ্গিরা। বিদেশিদের আনাগোনা বেশি থাকায় হামলার জন্য হলি আর্টিজান বেকারিকেই বেছে নেওয়া হয়।

রোহান ইমতিয়াজ হামলার নেতৃত্বে ছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে

পাঁচ তরুণ এই হামলায় অংশ নিলেও এই ঘটনার আগে-পরের কর্মকাণ্ডে আরও বেশ কয়েকজন জড়িত ছিলেন। নিজের গাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা হামলা চালানোর জন্য দিয়েছিলেন একজন, আরেকজন দিয়েছিলেন বিধর্মীদের ‘দয়া না দেখানোর’ নির্দেশনা।  

ঢাকার নামি স্কুল থেকে লেখাপড়া করা তিন তরুণসহ যে পাঁচজন এই হামলায় অংশ নিয়েছিলেন, তারা হামলার উদ্দেশে যাত্রা করার আগে পরস্পরের থেকে বিদায় নেন ‘জান্নাতে দেখা হবে’ বলে।

পাঁচ জঙ্গির মধ্যে ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইমতিয়াজ ওরফে ইলবাবাকেই সংগঠন থেকে হামলার নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।

বুড়িগঙ্গায় গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ নেন নিবরাজ ইসলাম, তার সঙ্গে রোহানও ছিলেন

এতে বলা হয়, “হলি আটিজানে হামলার আগে রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে ইলবাবা এবং নিবরাজ ইসলাম ওরফে লম্বু বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে নৌকা দিয়ে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা শেখে। ৫০০ টাকায় নৌকা ভাড়া করে এই প্রশিক্ষণের সময় মাঝিকে জিম্মি করা হয়। তাছাড়া গ্রেনেডের একটি স্লিন্টারে ইলবাবার পায়ে সামন্য আঘাত লাগে। পরে সদরঘাটের একটি ফার্মেসিতে তার চিকিৎসা দেওয়া হয়।”

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে রোহান ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মোহাম্মদপুর থানায় জিডিও করেছিল তার পরিবার।

বাবা-মায়ের সঙ্গে রোহান ইমতিয়াজ

ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) পরিদর্শক হুমায়ুন কবির আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে লিখেছেন, হামলার আগের দিন সকালে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার বিষয়ে নির্দেশনা দেন জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহান।

হামলার আগের দিন বৈঠক শেষে জোহরের নামাজ পড়ে সারোয়ার জাহান সবার উদ্দেশে বলেন, “আগামীকাল তোমরা হলি আর্টিজানে অপারেশন করবে, সেখানে বিদেশিদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি।”

পরে শুধু পাঁচজনের উদ্দেশে সারোয়ার বলেন, “তোমরা হলি আর্টিজান বেকারি হামলার সময় কখনো হতাশ হবে না। একজনের গুলি শেষ হলে আরেকজন ব্যাকআপ দেবে। মনে রাখবে আমাদের হারানোর কিছু নেই। অপারেশনের সময় তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। আর কোন মুশরেকদের উপর কোনো দয়া দেখাবে না। এমনকি সে যদি সাংবাদিকও হয়। সর্বদা জিকিরের মধ্যে থাকবে। যদি কেউ বন্দি হয়ে যায় তাহলে সে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেবে।

“আমরা যদি হোটেল হলি আর্টিজানের গেইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি তাহলে আমরা সফল। কারণ বিশ্ব জেনে যাবে যে, বাংলাদেশেও হামলা হয়েছে। আমাদের হারানোর কিছুই নেই, আমরা বিজয়ী।”

এই বক্তব্য দিয়ে সারোয়ার জাহান তার আশুলিয়ার বাসায় চলে যান। পরে ওই বছরের ৮ অক্টোবর আশুলিয়ার এই বাসায় র‌্যাবের অভিযানের সময় পালাতে গিয়ে পাঁচ তলা থেকে পড়ে আহত হন সারোয়ার জাহান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। আব্দুর রহমান নাম নিয়ে ওই বাসায় স্ত্রী-সন্তানসহ থাকা সারোয়ার জাহানই নব্য জেএমবির আমির বলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন র‌্যাব প্রধান।

২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যায় গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে অস্ত্রধারীদের হামলার খবর পেয়ে পাশের সড়কে অবস্থান নেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পরদিন সকালে সেখানে অভিযানে চালিয়ে পাঁচ জঙ্গিকে হত্যা করে কমান্ডোরা।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আগের দিনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর হামলাকারীরা সারা দিন কোরআন তেলাওয়াত ও নফল নামাজ পড়ে কাটায়। ঘটনার দিন সকালে হামলার জন্য প্রস্তুত পাঁচজনের জন্য জঙ্গি বাশারুজ্জামান চকলেট গুলশান-১ থেকে পাশে পকেটওয়ালা চারটি জলপাই রংয়ের এবং একটি ছাই রংয়ের গ্যাবাডিনের ফুল প্যান্ট কেনেন। এছাড়া তিনটি হালকা কালো রংয়ের, একটি নীল রংয়ের এবং একটি ছাই রংয়ের টি শার্ট কিনে আনেন তিনি।

পরে বাশারুজ্জামান চকলেট রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম ও মীর সামেহ্ মোবাশ্বেরের ব্যাগে তিনটি একে-২২ রাইফেল, তিনটি পিস্তল, তিনটি বড় চাকু, তিনটি গ্রেনেড, পর্যাপ্ত পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক এবং শফিকুল ইসলাম উজ্জল ও খায়রুল ইসলাম পায়েলের ব্যাগে পিস্তল, চাকু ও বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেন।

বাশারুজ্জামান চকলেট ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের এক বাড়িতে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। সারোয়ার জাহানের বাড়িও এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলার থুমরিভুজা গ্রামে।

ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ২ জুলাই জিম্মি উদ্ধার অভিযান শেষে সামরিক বাহিনীর কমান্ডোরা।

অভিযোগপত্র অনুযায়ী, হামলার দিন বিকাল ৫টার দিকে পাঁচজনের মধ্যে তিনজন একসঙ্গে বের হয়। এর প্রায় আধা ঘন্টা পর অপর দুইজন বের হয় বসুন্ধরার বাসা থেকে। তারা ‘জান্নাতে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ’ বলে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নেয়।

“রাত ৮টা ৪২ মিনিটে পাঁচজন হলি আর্টিজান বেকারির প্রধান ফটকে গেলে নিরাপত্তারক্ষী নূর ইসলাম তাদের পরিচয় জানতে চান। এ সময় কেউ কোনো কথা না বলে শুধু নিবরাস নিরাপত্তারক্ষীর মুখে ঘুষি মেরে অন্যদের নিয়ে বেকারির ভেতরে ঢুকে যায়। পরিস্থিতি বুঝে উঠার আগেই তারা গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পুরো বেকারি দখলে নিয়ে নেয় এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়।”

ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং শাখার সাবেক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী এই জঙ্গিদের বসুন্ধরার ওই বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বরের আজিমপুরের একটি বাসায় পুলিশের অভিযানে নিহত তানভীর তার ২০০৯ মডেলের সিলভার কালারের একটি এক্সিও প্রাইভেটকার সাড়ে ১২ লাখ টাকায় বিক্রি করে হলি আটিজান হামলার খরচ যুগিয়েছিলেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

কমান্ডো অভিযানের পরে হলি আর্টিজান বেকারি

এতে বলা হয়, কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্য জানান দেওয়া, বিদেশিদের হত্যা করে নৃশংসতা প্রকাশের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে প্রচার পাওয়াই এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল।

“এই হামলার আগে লেডিস ক্লাব, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা পার্ক, বনানী কফি শপসহ বিভিন্ন জায়গায় রেকি করা হয়। পরে বিদেশিদের অবস্থান বেশি হওয়ায় হলি আটিজান বেকারিকে বেছে নেওয়া হয়।”

দুই কর্মচারী দুর্ঘটনার শিকার

হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর কমান্ডো অভিযানে মোট ছয় জঙ্গি নিহত এবং এক জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে তাৎক্ষণিকভাবে বলা হয়েছিল।

হলি আর্টিজানে নিহত সাইফুল ইসলাম (ফাইল ছবি)

তবে তদন্তের পর এ বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, জঙ্গি পাঁচজনই ছিল। বাকি দুজন হলি আটিজান বেকারির কর্মচারী। তাদের মধ্যে নিহত সাইফুল ইসলাম চৌকিদার ছিলেন শেফ। আর আভিযানের সময় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া জাকির হোসেন শাওন ছিলেন রান্নাঘরের সহকারী।

“এই দুইজনের জঙ্গি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারা দুর্ঘটনার শিকার মাত্র।”

সেনাবাহিনীর সদস্যরা অভিযান শেষে ১৩ জনকে হলি আর্টিজান বেকারি থেকে উদ্ধার করে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া হামলার পর থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত ২৭ জন বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৯ জন সদস্যসহ আহত হন ৩১ জন।