ওসি মোয়াজ্জেমের রায় ২৮ নভেম্বর

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দির ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়ার মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের সাজা হবে কি না- সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে ২৮ নভেম্বর।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2019, 11:44 AM
Updated : 20 Nov 2019, 02:42 PM

বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন ওই দিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন।

বুধবার রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বিচারক রায়ের জন্য ২৮ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেন।  

সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত গত মার্চ মাসে তার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। সেসময় সোনাগাজী থানায় তার জবানবন্দি নেন তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।

তার কয়েক দিন পর মাদ্রাসার ছাদে অধ্যক্ষের সহযোগীরা নুসরাতের গায়ে আগুন দিলে সারাদেশে আলোচনা শুরু হয়। তখন নুসরাতের ওই জবানবন্দির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হলে গত ১৫ এপ্রিল ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করে ঢাকায় বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

পরিদর্শক মোয়াজ্জেমই ওই ভিডিও ছড়িয়েছেন- পিবিআইয়ের এমন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চার মাস আগে এ মামলার বিচার শুরু হয়, যা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের পর্যায়ে এল।

গত ১৪ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন এ মামলার একমাত্র আসামি পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেম হোসেন।

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি সেদিন বিচারককে বলেন, “এই অভিযোগে যত বড় শাস্তিই দেন না কেন, তার চেয়ে বড় শাস্তি আমি পেয়ে গেছি।”

ওই দিনই এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেছিলেন বিচারক।

সে অনুযায়ী বুধবার বিকালে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন এ আদালতের পিপি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম শামীম।

তিনি বলেন, “অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে আমরা মনে করি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারা অনুযায়ী আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আমরা আশা করছি।”

আদালতের বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২৬ ধারা অনুযায়ী অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড, ২৯ ধারা অনুযায়ী অনধিক তিন বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক পাঁচ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ড আর ৩১ ধারা অনুযায়ী অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে পুলিশ কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমের।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে বলেন, তার মক্কেল অভিযোগ থেকে খালাস পাবেন বলেই তার বিশ্বাস।

সবশেষ আদালতের অনুমতি নিয়ে মামলার বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও কিছুক্ষণ কথা বলেন।

এরপর আসামি মোয়াজ্জেম হোসেন ডায়াসের সামনে গিয়ে কথা বলতে শুরু করলে বিচারক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনাকে গত দিনই অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আপনি দীর্ঘ ৪৫ মিনিট বক্তব্য রেখেছেন।”

পরে বিচারক রায়ের তারিখ নির্ধারণ করে দেন বলে ট্রাইব্যুনালের পেশকার শামীম আল মামুন জানান।

বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন, নুসরাতের মা, ভাই ও দুই বান্ধবী, দুই পুলিশ সদস্য ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১২ জন এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন। আসামিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী এ মামলায় ছিল না।

গত ১২ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তার জেরা শেষে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরে ১৪ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন ওসি মোয়াজ্জেম।

তিন সেদিন বলেন, “গত ৬/৭ মাস আমাকে সারা বিশ্বে কলঙ্কিত করা হয়েছে। চাকরি থেকে আমাকে রংপুরে ক্লোজ করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে জুতা মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। অথচ আমি এই মামলায় আইওকে (তদন্তকারী কর্মকর্তা) সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়েছি। আমার মোবাইল তার কাছে জমা দিয়েছি।

“কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে এমন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে মামলা পড়েছে যিনি আইন অনুযায়ী তদন্ত করেননি। উনি (আইও) নিজেই তদন্তের প্রয়োজনে ছবি তুলেছেন।”

বিচারক তখন জিজ্ঞাসা করেন, জবানবন্দি নেওয়ার সময় তদন্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেমের কোনো ভিডিও করেছেন কি না। উত্তরে মোয়াজ্জেম বলেন, “না।”

“আমার থানায় সিসি ক্যামেরা আছে। আমি তদন্ত কর্মকর্তাকে যে স্ক্রিন শট দিয়েছি, সেখানে তারিখ দেখে তিনি ঘটনার সময় উল্লেখ করেছেন। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফায়েজ স্যার আমার কাছ থেকে ভিডিও নিয়েছে। সেটা আমি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি। আমি নিজে ফেইসবুক ব্যবহার করি না। শুধু ঘটনার পরদিন ৯ তারিখ রাতে এসপি সাহেব ফেইসবুকে একটি অ্যাকাউন্ট খুলে দেন। দুদিন পরই আমি তা আবার ডিঅ্যাক্টিভেট করে দিই।”

বিচারক তখন জিজ্ঞাসা করেন, মামলা দায়ের বা তদন্তের জন্য ভিডিও করার কোনো নির্দেশনা আইনে আছে কি না।

জবাবে মোয়াজ্জেম বলেন, “সেরকম কোনো আইন নেই। তবে আপডেটেড টেকনোলজির কারণে আমরা অনেক কিছু ভিডিও করে রাখি। এটা আমাদের প্র্যাকটিস, এক্ষেত্রে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কিছু নির্দেশনাও আছে।”

তখন বিচারক বলেন, “বাদী, সাক্ষী তো দূরে থাক, গ্রেপ্তারের পর আসামির ভিডিও বা ছবি না তোলার ব্যাপারে হাই কোর্টের নির্দেশনাই তো আছে।”

তখন মোয়াজ্জেম বলেন, “জি, তা আছে। এগুলো ভিডিও করে আমরা কাউকে দিই না। শুধুমাত্র আদালত চাইলে সাক্ষ্য হিসেবে তা উপস্থাপন করা হয়। আমরা এটা ফেইসবুক বা ইউটিউবে পোস্ট করি নাই। কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় গেছে তা আমি জানি না।”

আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন বিচারককে বলেন, “জ্ঞানতঃ আমি কোনো অপরাধ করি নাই। আমি মুসলমান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। আমি স্যারের কাছে ন্যায়বিচার চাই।”

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রীমা সুলতানা গত ২৭ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসামি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

আগাম জামিনের চেষ্টায় গত ১৬ জুন গোপনে হাই কোর্টে গিয়েছিলেন ওসি মোয়াজ্জেম। কিন্তু শুনানি হওয়ার আগেই পুলিশ শাহবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

১৭ জুন সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে জমিন নাকচ করে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক।

পরে ১৭ জুলাই আদালত আসামি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয়।

নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় তার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে গত ২৪ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দেয় ফেনীর নারী ও শিশুনির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। সেই রায় ডেথ রেফারেন্স হিসেবে শুনানির জন্য ইতোমধ্যে হাই কোর্টে গেছে।