পেঁয়াজের দাম দিয়েছে রসনায় লাগাম

খাবারে স্বাদ বাড়াতে পেঁয়াজের ভূমিকা অস্বীকার না করলেও এই নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাসিক বাজার খরচ ঠিক রাখতে অনেকে রান্নার স্বাদ কমিয়েছেন।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2019, 05:45 PM
Updated : 17 Nov 2019, 07:15 PM

গত দুই মাস ধরে বাজারে অস্থিরতার কারণে পাড়া-মহল্লার অনেক দোকানি পেঁয়াজ রাখাই বন্ধ করে দিয়েছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, রেস্তোরাঁগুলোও পেঁয়াজ কেনা কমিয়ে দিয়েছে।

নভেম্বরের মধ্যভাগে এসে বাংলাদেশের বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২১০ টাকা থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। অথচ বছরের অধিকাংশ সময়জুড়ে এই খাদ্য উপকরণটি বিক্রি হচ্ছিল কেজি ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে।

রোববার ঢাকার মিরপুর এলাকার অনেক মুদি দোকানে পেঁয়াজের সংগ্রহ শূন্যের কোঠায় দেখা গেছে। কারও কারও কাছে ছিল ১০ কেজি থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত।

দিনের ব্যবধানে দাম লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ায় পেঁয়াজে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না তারা। তাদের আশঙ্কা, যদি হঠাৎ দাম কমে যায়, তাহলে বড় লোকসান গুণতে হবে।

 

পেঁয়াজের এই সঙ্কটে ঘরে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার কেমন প্রভাব ফেলছে- খুঁজতে গিয়ে কম খাওয়ার বিষয়টি জানা যায়।

মিরপুর এলাকার রাঁধুনী তাসলিমা বেগম পীরেরবাগ এলাকায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার বাসায়, আরেকজন ক্ষুদ্র কারখানা মালিকের বাসাসহ তিনটি বাসায় রান্নার দায়িত্বে আছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, যে পাড়ায় তিনি থাকেন, সেখানে অনেক পরিবার এখন আর পেঁয়াজ খাচ্ছে না।

“আমি নিজেও আগে প্রচুর পেঁয়াজ খেতাম। তিন দিনে আমার এক কেজি পেঁয়াজ লাগত। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে এক কেজি পেঁয়াজ দিয়ে পার করছি। আরও তিনদিন চলবে বলে মনে হচ্ছে,” বলেন তাসলিমা।

 

ওই এলাকায় একটি বাড়ির কেয়ারটেকার বাবুল মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনেকে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না খেতে পারলেও তার পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে যায়। তাই পরিমাণে কমিয়ে হলেও তিনি পেঁয়াজ খাচ্ছেন।

“আগে আমি দিনে ৪/৫টা পেঁয়াজ খেতাম। ডিম ভাজাতে সবাই একটি করে পেঁয়াজ দিলেও আমি দিতাম দুটা। এখন অর্ধেক পেঁয়াজ সকালে খাই। বাকি অর্ধেক পেঁয়াজ বিকালের রান্নায় ব্যবহার করি,” বলেন বাবুল, যিনি নিজের রান্না নিজেই করেন।

বাঙালির খাবার পেঁয়াজ ছাড়া রোচেই না

বড়বাগ এলাকার রুহুল আমিনের মুদি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, চাল-ডাল, মসলাসহ অন্যান্য পণ্যে ভরপুর থাকলেও তার দোকানে পেঁয়াজ নেই।

রুহুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত চার দিন ধরে তিনি পেঁয়াজ বিক্রি করছেন না। চলতি মাসের ৮ তারিখে ৩০ কেজি পেঁয়াজ পাইকারি বাজার থেকে এনেছিলেন ১৬০ টাকা দরে। সেই পেঁয়াজের দাম উঠতে উঠতে ২২০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। চার দিন আগে সেই পেঁয়াজ বিক্রি শেষ হওয়ার পর আর আনেননি।

কেন আনছেন না- জানতে চাইলে রুহুল বলেন, “মানুষজন ১০ টাকার পেঁয়াজ নিতে আসে। অনেকে আড়াইশ গ্রাম পেঁয়াজও নিতে চায়। আবার অনেক পেঁয়াজ পচেও গেছে। তাছাড়া এক বস্তা পেঁয়াজের দাম উঠেছে ১০ হাজার টাকারও উপরে, যা আগে ছিল দেড় হাজার টাকা থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে এখন আর পেঁয়াজ আনছি না।”

ছাপড়া মসজিদের মুদি দোকান বাবলু স্টোরের বিক্রেতা বলেন, তার কাছে এখন ৩০ কেজির মতো পেঁয়াজ রয়েছে, যা নিয়ে তিনি ভয়ে আছেন। কারণ আগে যেখানে প্রতিদিন ২০ কেজি থেকে ৩০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হত, এখন সেখানে ৫ কেজিও বিক্রি হচ্ছে না। এর মধ্যে যদি দাম পড়ে যায়, তাহলে তার লোকসান হবে।

পেঁয়াজ যেন এখন মহার্ঘ্য

“মিরপুর শাহআলী মার্কেট থেকে ৯ হাজার টাকায় ৫০ কেজির একটি বস্তা কিনে এনেছিলাম গত ১১ তারিখে। সেই পেঁয়াজ এখনও বিক্রি করা যায়নি। মানুষজন নানা কথা শোনায় পেঁয়াজ নিয়ে। আমরা এখন প্রতি কেজি ২৪০ টাকায় বিক্রি করছি। কিন্তু বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।”

এই বাজারের আরেক বিক্রেতা আল আমিন দাবি করেন, দাম বেড়ে যাওয়ার পর পেঁয়াজ বিক্রি করে তেমন লাভ হচ্ছে না তাদের।

“আগে দেড় হাজার টাকায় ৪০ কেজি পেঁয়াজ কিনতাম। প্রতিদিন ২০ কেজি থেকে ৩০ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হত। কেজিতে ৫ টাকা করে আমাদের লাভ হত একশ থেকে দেড়শ টাকা। এখন ৮ হাজার টাকা থেকে ৯ হাজার টাকায় ওই পরিমাণ পেঁয়াজ পাওয়া যায়। সেই পেঁয়াজ বিক্রি করতে সময় লেগে যায় ১০ দিনের মতো। তাহলে আমাদের লাভটা কোথায়?”

খুচরা বিক্রেতাদের অতি মুনাফার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, অনেকে এই সময়ের মধ্যে কেজিতে ৩০/৪০ টাকা মুনাফা করেছেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি।

বাসাবাড়িতে অনেকে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করলেও রেস্তোরাঁয় তা একেবারেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন শাহ পরান হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক শফিকুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের মানুষের জিহ্বার সঙ্গে পেঁয়াজের স্বাদ মিশে আছে। এটা ছাড়া কিছু রান্না করলে তা হয় তো খাওয়া যাবে, কিন্তু অতটা ভালো হবে না। মাছ, মাংস, বিরিয়ানিসহ অন্যান্য খাবারে অবশ্যই পেঁয়াজ দিতে হবে।“

পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে এই প্রতিবাদ গাইবান্ধায়

তবে দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে রান্নায় পেঁয়াজের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেন শফিকুল।

তিনি বলেন, “আগে আমার এই হোটেলে এক বস্তা পেঁয়াজে দুই দিনও যেত না। প্রতিদিন ২০ কেজি থেকে ২৫ কেজি পেঁয়াজ প্রয়োজন হত। এখন যদি সেই একই পরিমাণ পেঁয়াজ ব্যবহার করি, তাহলে পোষাবো কী করে?”

শাহ পরান হোটেলে এখন কোনো সালাদে পেঁয়াজ দেওয়া হয় না। আর প্রতিদিন রান্নায় পেঁয়াজ ব্যববহার কমিয়ে আনা হয়েছে ৫ কেজিতে।

শফিকুল বলেন, “এই পেঁয়াজ খরচ করতে দিলে বাবুর্চি মানতে চায় না। তারা সব সময় যেই হিসাবে পেঁয়াজ ব্যবহার করে আসছে, তার চেয়ে কম দিলে অস্বস্তিতে ভোগে। বলে, রান্নার স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।”

অবশ্য ভিন্ন মত রয়েছে পল্লবী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আইরিন সুলতানার।

তার মতে, পেঁয়াজ রান্নার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান নয়। পেঁয়াজ ছাড়াও ভালো রান্না করা যায় এবং স্বাদেও হেরফের হয় না। এছাড়া পেঁয়াজ এড়িয়েও নিয়মিত রান্নার রেসিপিতে বৈচিত্র্য আনা যায়।

বাজারের পরিস্থিতিতে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করার চর্চা করছেন বলে জানান আইরিন।

 

গত সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। ৩০-৪০ টাকা থেকে দুই মাসে আড়াইশ টাকা ছাড়িয়ে যায় দাম। সঙ্কট কাটাতে সরকার মিসর, তুরস্ক, চীন থেকে আমদানির উদ্যোগ নিলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকার বাজারে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারও খুচরায় প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল আড়াইশ টাকা, মিয়ানমারের পেঁয়াজ ২৩০ টাকা এবং মিশরের পেঁয়াজ ১৮০ টাকা থেকে ২১০ টাকার মধ্যে।

তবে তিন দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কম দেখা যায় রোববার।

রোববার মিরপুর এলাকায় খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ২২০ টাকা থেকে ২৩০ টাকার মধ্যে। পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজ ছিল ১৯০ টাকার মধ্যে। এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি ১৪০ টাকা থেকে ১৬০ টাকায় নতুন মওসুমের মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কিছু কিছু এলাকায়।