নিজের যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে বার বার তার মুখ থেকে ফিরছিল কিশোরী মেয়ে ফারজানাকে হারানোর কথা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৫ জনের সঙ্গে অকালে ঝরে গেছে এই এসএসসি পরীক্ষার্থীর প্রাণ।
হাসপাতালে বিলাপের সুরে রোজিনা বলছিলেন, “ভূমিকম্প আইলে যেমন মাইনষের বিল্ডিং ভাঙ্গে, তেমন কইরা ভূমিকম্পের মতো আমার সব কিছু শ্যাষ হইয়া গেছে।”
বিভীষিকাময় সেদিনের ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, “আমি সব কিছু ভুইলা যাইতে চাই, কেউ আমারে কিছু জিগাইয়েন না। আল্লাহ আমারে বাঁচায়া রাখসে সহ্য করার লাইগা, আমার বুকটা ফাইটা যায়, আমারে কেউ কিছু জিগাইয়েন না।”
শ্রীমঙ্গলে বোনের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন রোজিনার পরিবারের আট সদস্য। গন্তব্য কুমিল্লা, কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর।
গুরুতর আঘাত নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে তার সঙ্গে ভর্তি আছেন তার মা, ভাইয়ের স্ত্রী শাহিদা বেগম এবং ছেলে চাঁদপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হাসান ব্যাপারী।
গত মঙ্গলবার ভোর রাত সোয়া ৩টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১৬ জন নিহত হন। আহত হন আরও অর্ধশতাধিক যাত্রী।
বৃহস্পতিবার পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত আগারগাঁওয়ের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে কিছুক্ষণ পরপর যে চিত্র দেখা যায়, তা ছিল হৃদয়বিদারক। বিলাপের স্বরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল স্বজন হারানোর বেদনা।
পায়ে আঘাত নিয়ে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন চট্টগ্রামের মামিয়া গার্মেন্টে কর্মরত মহিন আহমেদ সোহেল (৩৩)। দুর্ঘটনায় তিনি হারিয়েছেন তার দুই বছর বয়সী আদরের মেয়েকে সোহাকে।
একই ওয়ার্ডে দুই পা ও ডান হাত ভাঙা নিয়ে একটু পর পর কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সোহেলের স্ত্রী, সোহার মা নাজমা খানম (২৮)। তিনিও কাজ করেন একটি পোশাক কারখানায়।
তাদের বড় ছেলে নাফিজের (সাড়ে চার বছর) ডানহাতের হাড় স্থানচ্যুত হয়েছে। আতঙ্কের কারণে নাফিজ টানা তিন দিন কথা বলেনি বলে জানান মা নাজমা।
চোখের সামনে নিজের শিশু সন্তানের মৃত্যু দেখার করুণ অভিজ্ঞতার কথাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে বর্ণনা করেন এই মা।
“ভাবছিলাম ট্রেনে জীবনের নিশ্চয়তা থাকে, কিন্তু এখন নিজ চোখে দেখলাম কোথাও কোনো নিশ্চয়তা নাই,” দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নাজমা।
একই ট্রেনে ছিলেন নাজমা খানমের মা। তিনি আহত অবস্থায় ভর্তি আছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে।
পঙ্গু হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি আছেন সুরাইয়া খাতুন নামে ষাটোর্ধ্ব এক নারী। তার দুই পা ভেঙে হাড় থেকে মাংস আলাদা হয়ে গেছে।
সুরাইয়া খাতুনের পরিবারেরও ছয়জন চেপেছিলেন উদয়ন এক্সপ্রেসের ‘ঝ’ বগিতে। দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তার বড় মেয়ে জায়েদার (৪৮)। মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ এখনও জানানো হয়নি তাকে।
সুরাইয়া খাতুনের পুত্রবধূ নিলুফা বলেন, “এত বড় ক্ষত নিয়েও তার মানসিক অবস্থা অনেকটা শক্ত আছে, কিন্তু তাকে জায়েদা আপার মৃত্যুর খবর দেওয়া হয় নাই।”
সুরাইয়ার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে পঙ্গু হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “সুরাইয়া খাতুনের অবস্থা একটু খারাপ। তার বুকের হাড় এবং দুই পা ভেঙে গেছে। এর মধ্যে বাঁ পায়ের অবস্থা বেশি খারাপ। ভবিষ্যতে নাও টিকতে পারে। তবে নিশ্চিত হয়ে বলা সম্ভব না।”
পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় তলায় ওয়ার্ড বি-তে ভর্তি আছেন আবুল কালাম (৪৫), হোসেন আলী (৬৫) এবং চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার জামিয়াতুল মদীনাহ মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান (১৪)।
হাসপাতালে ভর্তি আহতদের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মহিন আহমেদ সোহেলের পেট থেকে ফ্লুইড এবং ব্লাড কালেকশনের জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে যতটুকু দরকার চিকিৎসা শেষে তাকে প্রয়োজনবোধে আবারও এখানে চিকিৎসা দেওয়া হবে।”
এছাড়া আবুল কালামের বাঁ পায়ের হাঁটুর উপরে এবং নিচে তিনখণ্ড হয়ে গেছে বলে জানান চিকিৎসক জাহাঙ্গীর।