গ্রেপ্তার সগিরার ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী (৭০), তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন (৬৪), শাহিনের ভাই আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান (৫৯) এবং মো. মারুফ রেজা (৫৯) এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টেগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, স্ত্রীর কথায় প্ররোচিত হয়ে ছোট ভাইয়ের বউকে শায়েস্তা করার জন্য ২৫ হাজার টাকায় সে সময় বেইলি রোড এলাকার ‘সন্ত্রাসী’ মারুফ রেজাকে ভাড়া করেছিলেন ডা. হাসান। মারুফকে সহযোগিতার জন্য স্ত্রীর ভাই রেজওয়ানকে দায়িত্ব দেন।
এখন আবাসন ব্যবসায়ী ও বেইলি রোডের বাসিন্দা মারুফ রেজা এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে। ওই সময়ই তিনি গ্রেপ্তার হলেও তার নাম বাদ দিয়ে মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছিল পুলিশ। এরপর বিচার শুরু হলেও সাক্ষ্যে মারুফ রেজার প্রসঙ্গ উঠে আসায় অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারিক আদালত। পরে উচ্চ আদালতে গিয়ে এই মামলা আটকে দেন মারুফ রেজা।
যেভাবে খুনির সন্ধান
ডিআইজি বনজ কুমার বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মলনে জানান, গত ২৬ জুন হাই কোর্ট ৩০ বছর আগের এই মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমে বাদীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা। পরে অনেক চেষ্টার পর বের করা হয় সগিরা মোর্শেদকে বহনকারী সেদিনের যুবক রিকশাচালককে।
বর্তমানে ৫৫ বছর বয়সী ওই রিকশাচালক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, মটরসাইকেলে আসা দুইজনের একজনকে দেখে সগিরা মোর্শেদ বলে উঠেন ‘তুমি এখানে কেন? আমি তোমাকে চিনি’।
‘এই চেনা ব্যক্তির’ পরিচয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে পেয়ে যায় পিবিআই। রিকশাচালক তার শারীরিক যে বিবরণ দেন, সেই বর্ণনা আর বাদীর বক্তব্যের সাথে মিলে যায় তাদের পরিচিত একজনের চেহারা।
বনজ কুমার জানান, সগিরা মোর্শেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। রাজারবাগে একই বাড়িতে থাকা তার বড় দুই জায়ের একজন ছিলেন ডিগ্রি পাশ (গ্রেপ্তার শাহীন), অন্যজন উচ্চ মাধ্যমিক (বড় ভাবী)। এসব নিয়ে নানা ছুঁতায় পারিবারিক সমস্যা লেগেই থাকত। তার থেকেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
বুধবার হাসান আলী ও তার স্ত্রী মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের খাসকামরায় স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বৃহস্পতিবার জবানবান্দি দেন রেজওয়ান ও মারুফ রেজা।
সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মকর্তারা জানান, রেজওয়ান জবানবন্দিতে ‘শ্যুটার’ মারুফ রেজাকে ওই দিন সগিরা মোর্শেদকে চিনিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। ওই সময় দুজনই মটরসাইকেলে ছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম বলেন, “সগিরা মোর্শেদকে রেজওয়ান চিনিয়ে দেওয়ার পরপরই মারুফ রেজা গুলি করে। তার আগে সগিরা মোর্শেদের হাতের বালা নেওয়ার জন্য টানাটানি করে। রিকশা থেকে পড়ে যাওয়ার পর আরও কয়েক রাউন্ড গুলি করে পালিয়ে যায় তারা।”
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, যে অস্ত্র দিয়ে সগিরা মোর্শেদেকে গুলি করা হয় সেই অস্ত্রটি তৎকালীন সন্ত্রাসী মুন্নার কাছ থেকে মারুফ নিয়েছিলেন, যা পরে ফেরত দিয়ে দেন। এই অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে মুন্নার খোঁজ করতে জানা যায়, অনেক আগে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন তিনি।
“মারুফ রেজা ভাড়াটিয়া খুনি হলেও ডা. হাসান আলী চৌধুরীর নিয়মিত রোগী ছিল এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় পূর্ব পরিচিত ছিল। সেই থেকেই তাকে ঠিক করেন ডা. হাসান।”
জায়ে জায়ে রেষারেষি
বনজ কুমার মজুমদার জানান, ডা. হাসান ১৯৮০ সালে সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে বিয়ে করেন। ওই বছর ২২ জুন স্ত্রীকে নিয়ে লিবিয়ায় চলে যান তিনি। ১৯৮৫ সালে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডে রাজারবাগে বাবার বাসায় মা, বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে নিচতলায় একসাথে কিছু দিন বসবাস করেন। পরে ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় ছোট ভাই সালামের বাসার একটি কক্ষে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতে শুরু করেন।
“এক বাসায় থাকার কারণে গৃহস্থালি নিয়ে ডা. হাসানের স্ত্রী শাহিনের সাথে সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাস ছয়েক একসঙ্গে থাকার পর ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ওই ভবনের তৃতীয় তলার কাজ হয়ে গেলে হাসান পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় উঠেন।
“এই সময় তৃতীয় তলা থেকে ময়লা ফেলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শাহিনের সাথে সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।”
“এসব কারণে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য ডাক্তার স্বামীর সাথে শলাপরামর্শ করে শাহীন। স্বামী এতে সম্মতি দেন। এরপরেই রেজওয়ানের সাথে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়,” বলেন বনজ কুমার।
এখানেও ‘জজ মিয়া নাটক’
১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে সগিরা মোর্শেদ সালাম আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। ওই দিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলা করেন তার স্বামী সালাম চৌধুরী।
গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. জালাল শেখ মামলার তদন্ত করে মিন্টু নামে এক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে ১৯৯০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি আসামি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবু বকর সিদ্দিক। সাক্ষ্য নেওয়া হয় সাতজনের।
সাক্ষ্যে বাদীপক্ষ থেকে বলা হয়, তদন্তকালে আসামি মিন্টু এবং তৎকালীন (১৯৮৯) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজা গ্রেপ্তার হন। কিন্তু মারুফ রেজার নাম বাদ দিয়েই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজার রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাই কোর্ট মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ ও বিচারকাজ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার পাশাপাশি অধিকতর তদন্তের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে।
পরের বছর ২৭ অগাস্ট জারি করা রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই মামলার বিচারকাজ স্থগিত থাকবে বলে আরেকটি আদেশ দেয় হাই কোর্ট।
পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলছেন, ওই মিন্টুকে এখন খুঁজছেন তারা।
“ধারণা করছি, মিন্টু জজ মিয়ার মতো নাটকের শিকার হতে পারেন। তাকে পাওয়া গেলে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে।”