সৌদি আরবে নারীকর্মী না পাঠানোর দাবি সংসদে

সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়ে একের পর এক গৃহকর্মীর ফিরে আসার পরিপ্রেক্ষিতে রক্ষণশীল ওই দেশটিতে আর নারী শ্রমিক না পাঠানোর দাবি উঠেছে সংসদে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2019, 02:16 PM
Updated : 12 Nov 2019, 02:23 PM

সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে এই দাবি তোলার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেছেন, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের সমস্যাটি নিয়ে সরকারও চিন্তিত।

কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো শুরুর পর থেকে সেদেশে গৃহকর্তার হাতে নানা ধরনের নির্যাতনের খবর আসতে থাকে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল না।

এ বছর জানুয়ারি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত আট মাসে ৮৫০ জন নারী দেশে ফিরে আসার পর তাদের মুখে সেখানে যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতনের খবর গণমাধ্যমে আসার পর বিভিন্ন নারী সংগঠন সৌদি আরবে আর নারীকর্মী না পাঠানোর দাবি তোলে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে মঙ্গলবার আইনসভায় একই দাবি ওঠে। সংসদে বিষয়টি আলোচনায় তোলেন জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুল হব চুন্নু।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর কাছে এক সম্পূরক প্রশ্নে তিনি বলেন, “সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার ও যৌন নির্যাতন করা হয়। এটা একটা স্বীকৃত বিষয় যে- অনেক নারী কর্মী নির্যাতনের কারণে পালিয়ে যায়। তারা জেলে যাচ্ছে, বাংলাদেশে ফেরত আসছে। বহির্বিশ্বে নারী কর্মী পাঠানো নিয়ে নানা প্রশ্ন আসছে।”

নারী কর্মীদের যৌন নির্যাতন বন্ধ করে চাকরিসহ বেতন নিশ্চিত করতে সরকারের পদক্ষেপ জানতে চান তিনি।

জবাবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান বলেন, “গৃহকর্মীর বিষয়ে আপনারা যতটা চিন্তিত তার থেকে বেশি সরকার চিন্তিত। এ ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেওয়া হয়েছে।”

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ

কয়েকদিন আগে ঢাকাস্থ সৌদি আরব দূতাবাসের শার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সকে তলবের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেখানে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের সৌদি আরবে যে রাষ্ট্রদূত রয়েছে তাকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এগুলো তোলার জন্য।”

মন্ত্রী জানান, আগামী ২৬-২৭ নভেম্বর জয়েন্ট টেকনিক্যাল গ্রুপের একটি বৈঠক সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও এই প্রশ্নগুলো তোলা হবে।

এরপর সংসদে বিষয়টি নিয়ে একের পর এক প্রশ্নে পড়েন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী; এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ।

তিনি বলেন, “বলা হচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে কর্মী পাঠায়। তাহলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বটা কী? মা-বোনদের আমরা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওই খান থেকে যৌন নির্যাতনসহ নানা রকম অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে অবশেষে লাশ হয়ে ফিরে আসে। এদের সকলেই পোস্টমর্টেমে লেখা থাকে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’।

“সকলেরই একই রকম রিপোর্ট। এটা তারা (সৌদি আরব) করে। ওখানে পোস্টমর্টেম যে হয়, সেটাও বাংলাদেশ দূতাবাস দেখে না। মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নেয় না।”

জাতীয় পার্টির এই নেতা বলেন, “এভাবে আমাদের মা-বোনদের নিয়ে কি ব্যবসা করতে পারি? স্বাধীন দেশ হিসেবে আমাদের সম্মান আছে, ইজ্জত আছে। মাত্র কয়েকটি টাকার জন্য কেন তাদের পাঠাতে হবে? অবিলম্বে এটা বন্ধ করতে হবে।”

মন্ত্রীর উদ্দেশে ফিরোজ রশীদ বলেন, “একেকজন মহিলা ফেরত আসে, আপনি (মন্ত্রী) দেখেন না, তাদের উপর কী অন্যায় অত্যাচার করা হয়? আমাদের ঘরে বা বোন নেই? কেন কয়েকটি টাকার জন্য তাদের পাঠাব?”

সৌদি আরবে নারীদের পাঠানো বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “পাঠিয়েছে দালালরা, আর উনি (মন্ত্রী) খালাস! দালালরা নিয়ে তাদের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। বেচাকেনা হচ্ছে রীতিমতো। মেয়েদের হাট বসে, কে কত দাম দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে! আমরা কেন এটার খবর রাখি না?

“স্পষ্টভাবে জানতে চাই, এটা অবিলম্বে বন্ধ হবে কি না? মা-বোনদের পাঠিয়ে দেশ বিক্রির টাকা আমাদের দরকার নেই। বন্ধ করবেন কি না?”

তার প্রশ্নের জবাব দিয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, “এটা মাঠের বক্তৃতার মতো। এই হাউজকে জানাতে চাই- যেসব নারী লাশ হয়ে বা নির্যাতিত হয়ে আসছে... গত কয়েক মাসে ১৬০টি ট্রাভেল এসেন্সির লাইসেন্স স্থগিত করে রেখেছি। তিনটি লাইসেন্স বাতিল করেছি। দোষীদের জরিমানাও করেছি। আমরা জিরো টলারেন্সে আছি।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা আইন করে দিচ্ছি। যারা বিদেশ পাঠাবে সৌদি আরবে ওদের কাউন্টার পার্ট রিক্রুটিং এজেন্সির সম্পূর্ণ ডিটেইলস আমাদের দিতে হবে। যাতে সৌদি আরবকেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলতে পারি।”

সৌদি আরবে নারী শ্রমিকদের পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উপর জোর দেন বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী; তার মতে, এটাও সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার একটি কারণ। এজন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

প্রশিক্ষণ দিয়ে নারী শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য সুলতান মনসুর আহমেদ বলেন, “আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদি আরবে পাঠাব, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে তো তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। নিয়ন্ত্রণ তো করবে ওরা (সৌদি আরব)।

“কাজেই আমার অনুরোধ থাকবে, আমাদের সমাজ জীবনকে বাঁচানোর জন্য এবং এই দেশের মান মর্যাদা ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে মহিলা শ্রমিক না পাঠিয়ে পুরুষ শ্রমিককে দ্বিগুণ ভাবে পাঠানো হোক।”

এই প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী মন্ত্রী বলেন, “সৌদি আরব, মালয়েশিয়া বা যে দেশেরই শ্রমবাজার বলেন, তাদের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী পাঠাতে হয়, না হলে পাঠানোর দরকার নেই।

“আমাদের চেষ্টা থাকবে মহিলারা যেন সম্মানজনকভাবে চাকরি করতে পারেন। আর একেবারেই যদি সম্ভব না হয় তাহলে আমরা না পাঠানোর চিন্তা করব।”

সংরক্ষিত আসনের বেগম ওয়াসিকা আয়শা খানের প্রশ্নের জবাবে বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী জানান, ১৯৯১ সাল থেকে বিদেশে নারীকর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুন থেকে এ পর্যন্ত ৭৪টি দেশে আট লাখ ৬৮ হাজার ৩৬৩ জন নারীকর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৯০ জন।

এছাড়া জর্ডানে এক লাখ ৫৩ হাজার ২৯১ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক লাখ ২৬ হাজার ১৪৩ জন, লেবাননে এক লাখ ৬ হাজার ৪৪৪ জন, ওমানে ৮৫ হাজার ৯১৪ জন, কাতারে ৩২ হাজার ২৮০ জন, মরিশাসে ১৮ হাজার ৩৩১ জন নারীকর্মী পাঠানো হয়।

বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, যা তুলে ধরে বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেন, দেশের স্বার্থেই বিদেশে শ্রমিক পাঠানো হয়।

তবে নারী শ্রমিকদের বিদেশে গিয়ে লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসার এই সমস্যা ঠেকাতে সংসদ সদস্যরা কোনো পরামর্শ দিলে সরকার তা গ্রহণ করবে বলে জানান তিনি।