যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে অপসারণ

যুদ্ধাপরাধ মামলার এক আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে আইনজীবী তুরিন আফরোজকে অপসারণ করেছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2019, 07:34 AM
Updated : 11 Nov 2019, 11:19 AM

আসামির সঙ্গে বৈঠক করে তুরিন রাষ্ট্রদ্রোহের মতো অপরাধ করেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার এক সহকর্মী।

অন্যদিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই ধরনের পদক্ষেপে হতাশা প্রকাশ করেছেন তুরিন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তুরিন আফরোজকে অব্যাহিত দেওয়াটা ‘জরুরি’ হয়ে পড়েছিল।

আসামির সঙ্গে বৈঠকের খবর প্রকাশ পাওয়ায় গত বছরের মে মাসে তুরিন আফরোজকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

সোমবার আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। এতে তুরিনের ‘শৃঙ্খলা ও পেশাগত আচরণ ভঙ্গ এবং গুরুতর অসদাচরণের’ কথা বলা হয়।

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। 

গত বছর এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন।

ওই অভিযোগ ওঠার পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ওয়াহিদুল ও তুরিনের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিওরেকর্ডসহ যাবতীয় ‘তথ্য-প্রমাণ’ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ট্রাইব্যুনালের সব মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তুরিনকে।

তুরিন সে সময় অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি। এক ফেইসবুক পোস্টে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও ওই গোপন বৈঠকের কথা তিনি অস্বীকার করেননি।

অপসারণের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, “তার (তুরিন) কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রবিরোধিতার শামিল। কারণ এটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার) রাষ্ট্রের অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়।”

তুরিন কেবল পেশাগত অসদাচরণ বা শৃঙ্খলা ভঙ্গই করেননি, তিনি ফৌজদারি আপরাধও করেছেন বলে মন্তব্য করেন মালুম। সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবে বলেও প্রত্যাশা করেন এই প্রসিকিউটর।

মালুম বলেন, “প্রসিকিউশন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরও তুরিন আফরোজ প্রসিকিউটরদের বরাদ্দকৃত বেতন-ভাতা নিয়মিত গ্রহণ করে এসেছেন। গত মাস পর্যন্ত গ্রহণ করেছেন। একইভাবে সরকারি গাড়ি, গানম্যান পেয়ে আসছিলেন। প্রটেকশন প্রটোকল পেয়ে আসছিলেন এবং তার বাড়িতে হোম গার্ডও পেয়ে আসছিলেন। আজকে অপসারণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবেই সব সুযোগ-সুবিধাও বাতিল হয়ে যাবে।”

মালুম বলেন, “প্রসিকিউশনের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার কাছে বিভিন্ন মামলার দলিলপত্র, বিশেষ করে ওয়াহিদুল হকের মামলায় যে পর্যন্ত তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন, সে সময় পর্যন্ত নথিপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদনের অংশ রয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত সেসব তিনি জমা দেননি। আশা করি, নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করে এগুলো তিনি জমা দিয়ে দিবেন।”

তুরিনের আগে পেশাগত অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ২০১৬ সালে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলীকে প্রসিকিউশন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তার বিষয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি সরকার থেকে।

জানতে চাইলে তুরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, আমি একশভাগ সতততার সাথে কাজ করে গেছি। জ্ঞানত আমি এমন কিছু করিনি, যাতে আইন ভঙ্গ করেছি বা কোনোভাবে আস্থা ভঙ্গ করেছি।

“আমি শুনেছি এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি হবে, সেখানে নিদেন পক্ষে আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন দেওয়ার জন্য ডাকা হবে। না ডেকেই একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া হল। তারপরও এ সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিচ্ছি। মেনে নিতেই হবে।”

তুরিন আফরোজ (ফাইল ছবি)

তুরিন বলেন, “একজন যুদ্ধাপরাধীকেও ট্রাইব্যুনাল আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়। পরে প্রমাণ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অপরাধের প্রমাণ হয়। আর আজকে একজন যুদ্ধাপরাধী এসে বলল তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে, অভিযোগ করল আর সেটাই সত্যি হয়ে গেল! তুরিন আফরোজকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হল না।”

একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কাজে সম্পৃক্ত তুরিন বলেন, “প্রসিকিউশনে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এজন্য আমি গর্ববোধ করি। সম্মানের সাথে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের একটা অংশ আমি হয়েছি। এত কিছুর পরও আমি চাই বিচার চলুক, আরও সফলতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাক। এর বাইরে যেটুকু বলার আছে সেটুকু আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলব।”

যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের তিন বছরের মাথায় প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মামলা পরিচালনায় ভূমিকা রাখেন তিনি। তাকে ওয়াহিদুল হকের মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের নভেম্বরে।

পরের বছর মে মাসে তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছিলেন, ওয়াহিদুল হককে গ্রেপ্তার করার সময় গুলশান থানার ওসি তার মোবাইল ফোন জব্দ করেছিলেন। ওই মোবাইলে কথোপকথনের দুটি রেকর্ড ছিল। একটি কথোপকথন হয়েছে টেলিফোনে। সেখানে তুরিন আফরোজ আসামি মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হককে দাওয়াত দিয়েছেন দেখা করার অনুমতি চেয়ে। ফোনটা তুরিনই করেছিলেন।

“অন্য রেকর্ডটি ছিল দুই ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের। এই কথপোকথনে মামলা সংক্রান্ত অনেক কথা রয়েছে এবং মামলার ডকুমেন্ট হস্তান্তরের কথোপকথন রয়েছে। ওসি এটা পাওয়ার পর সে মনে করল যে, আমাদের জানানো দরকার। আমরা এটা হাতে পাওয়ার পর প্রসিকিউশনকে দিয়েছি।”

তদন্তাধীন মামলার আসামির সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো আইনজীবীর গোপনে দেখা বা সাক্ষাৎ নৈতিকতাবিরোধী মন্তব্য করে সানাউল সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত কথা হচ্ছে উনি এ মামলা তদন্ত করেন না। তদন্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান। ফেইসবুকে দেখলাম উনি (তুরিন আফরোজ) গোপনে তদন্ত করতে চেয়েছিলেন আমাদের জানিয়েছেন। কিন্তু এ রকম কোনো নিয়ম নেই আমাদের তদন্তে।”

‘জরুরি হয়ে পড়েছিল’

তুরিনকে অপসারণের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, এই পদক্ষেপ নেওয়া ‘জরুরি’ হয়ে পড়েছিল।

“তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি একজন আসামির সাথে, যে মামলা তিনি নিজে করছিলেন, তার সাথে আলাপ আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। মামলার আলোচনা করার সময় এও বলেছিলেন এ মামলায় কোনো সারবর্তা নেই। সেই যে কথোপকথন টেপ করা হয়, টেপ করা কথোপকথনগুলো এবং তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অভিযোগ আমাদের কাছে পাঠান। এ অভিযোগ নিয়ে সাক্ষীদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং উনার সাথে কথা বলার প্রয়োজন যতটুকু মনে করি হয়েছিল। যে সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে, সেগুলো কিন্তু অল আর ডকুমেন্টরি। সেই জন্য আমরা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অব্যাহিত দিয়েছি।”

আনিসুল হক

তুরিনের আগের কাজে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে আনিসুল হক বলেন, “যে কারণে আজ তাকে অব্যাহতি দেওয়া হল, তার আগ পর্যন্ত তিনি কিন্তু নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন।

“এ ব্যাপারে তার সেন্স অব জাজমেন্ট কেন কাজ করেনি আমি জানি না, তার দিক থেকে এসব বক্তব্য যেটা ধারণ করা হয়েছে, যেটা তার গলা বলে প্রমাণিত হয়েছে, এটা উনি কেন করলেন, আমরা বুঝতে পারছি না। এটা দুঃখজনক।”

অপসারণের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “কাজটা যে আমি খুশি হয়ে করেছি, তা না। কিন্তু তাকে অব্যাহতি দেওয়াটা জরুরি হয়ে পরে। কারণ যে মামলা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই মামলায় চার্জ গঠন হয়ে গেছে, সেই কারণে আমার মনে হয় এই ব্যাপারটি একটি নিস্পত্তি টানা দরকার ছিল, সেজন্য এটা করা হয়েছে।”

তুরিনের কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ  বলে মন্তব্য এসেছে, এক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমি তো এ রকম কথা বলতে পারব না, আমার এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য নেই।”

তুরিনকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তার সাথে কথা হয়েছে, যে প্রমাণাদি আছে, সেটা যদি এখন ইয়ে করতে চান, সেটা তো ওপেন। কিন্তু টেপ করা কথাবার্তা আমরা পেয়েছি এবং তার বিরুদ্ধে নালিশ হয়েছে এবং আমরা সার্বিকভাবে আলোচনা করার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”

এটা চলমান শুদ্ধি অভিযানের অংশ কি না- প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “আমরা আশা করি, যে আইনজীবীরা এ কাজে নিয়োজিত আছেন, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সজ্ঞান। তাদের নতুন কোনো মেসেজ দিতে হবে বলে আমি মনে করি না।

“এখানে যদি শৃঙ্খলার বাইরে কোনো কাজ করা হয়, যেটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বা তার মান ক্ষুন্ন করতে পারে, তাহলে তো ব্যবস্থা নেবই।”