দমকা হাওয়ায় গাছ ও ঘর চাপা পড়ে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে দশ জেলায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা, বরগুনা ও গোপালগঞ্জে দুজন করে এবং পটুয়াখালী, ভোলা, শরীয়তপুর, পিরোজপুর, মাদারীপুর, বরিশাল ও বাগেরহাটে একজন করে মারা গেছেন।
এর বাইরে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামে আবুল কালাম নামে ৪০ বছর বয়সী এক মাছ চাষী শনিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।
পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসার পর সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের কাছ দিয়ে এ ঝড় পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করে। তারপর রোববার ভোর ৫টার দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছায়। বৃষ্টি ঝরিয়ে শক্তি হারিয়ে সকালে বুলবুল পরিণত হয় গভীর স্থল নিম্নচাপে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে চার থেকে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এরপরে বিভিন্ন জেলা থেকে ঘরবাড়ির পাশাপাশি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য এসেছে।
আমাদের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
খুলনা
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে খুলনায় দুইজনের মৃত্যুর পাশাপাশি তিন হাজারেরও বেশি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এর মধ্যে কয়রা উপজেলায় দেড় হাজার এবং দাকোপ উপজেলায় ১ হাজার ৭৬৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া দাকোপ উপজেলায় ৩১৫টি চিংড়ির ঘের ও ৪২৫টি পুকুর ভেসে গেছে।
রোববার সকালে খুলনার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির এই হিসাব দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।
ঘূর্ণিঝড়ে এই দুই উপজেলার কয়েক হাজার গাছপালা উপড়ে গেছে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক বলেন, ঝড়ে মহানগরেও অনেক বাড়িঘর ও গাছপালা ভেঙে গেছে। গাছ পড়ে যান চলাচল বন্ধ হয় অনেক সড়কে। বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে গোটা খুলনা জেলা।
দুপুরের পর থেকে বিদ্যুৎ ও সড়ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তবে বিকেল থেকে আবার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। মৃদু শীতও অনুভূত হচ্ছে।
দাকোপের ইউএনও আবদুল ওয়াদুদ জানান, প্রমীলা শনিবার রাতে দক্ষিণ দাকোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে ছিলেন। সকাল ৯টা-সাড়ে ৯টার দিকে নিজের বাড়িতে যান তিনি।
“এ সময় একটি গাছ তার উপরে পড়লে প্রাণ হারান প্রমীলা।”
দিঘলিয়া থানার ওসি মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, উপজেলার সেনহাটি গ্রামে সকাল ৯টার দিকে নিজের বাসার পাশে অবস্থান করছিলেন আলমগীর হোসেন। এ সময় একটি সজনে গাছ ভেঙে তার উপরে পড়লে আহত হন তিনি।
স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে দিঘলিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
সাতক্ষীরা
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল উপকূল অতিক্রম করার পর সাতক্ষীরায় ঝড়ের দাপট শুরু হয় ভোর পৌনে ৪টার দিকে। প্রবল ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হয় ভারী বর্ষণ।
সাতক্ষীরা জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকা অতিক্রম করার সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮১ কিলোমিটার।
জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল জানান, ঝড়ে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব অঞ্চলে মাছের ঘের ও ফসলি জমির পাশাপাশি রাস্তঘাটেরও ক্ষতি হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে জেলায় ২৫ হাজার হেক্টর আমন ধান, ১২ শ হেক্টর জমির সবজি, ৫০০ হেক্টর জমির সরিষা, ২০০ হেক্টরের কুল ও ১২০ হেক্টর জমির পান নষ্ট হওয়ার তথ্য পাওয়ার কথা বলেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক অরবিন্দ বিশ্বাস।
এ জেলায় মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার মানুষকে ঝড়ের আগে আশ্রয় কেন্দ্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বিপদ কেটে যাওয়ার পর তাদের অনেকে ফিরে যেতে শুরু করেন। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও সেনাবাহিনী উদ্ধার কাজ শুরু করে বলে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।
ওই এলাকার কিছু বেঁড়িবাধ ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “নদীতে পানি বাড়ায় সাধারণ মানুষকে সাথে নিয়ে আমরা বাঁধ মেরামত করার চেষ্টা করছি। এখন জোয়ার চলছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।”
শ্যামনগরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, তার এলাকার অধিকাংশ কাঁচা ঘর ঝড়ে নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘের ও ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। গাছ ভেঙে পড়ে কিছু এলাকায় সড়ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গাছ সরিয়ে যাতায়াতের ব্যবস্থা হলেই উদ্ধার কাজ শুরু হবে।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গাজী মাসুদুল আলম বলেন, “আমার ইউনিয়নের চার হাজার ঘর ভেঙে গেছে। মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। অনেক গাছ উপড়ে গেছে।”
রাতে ঝড়ের মধ্যে গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামে আবুল কালাম নামে ৪০ বছর বয়সী এক মাছ চাষী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, “তার মৃত্যুর সাথে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কোনো সম্পর্ক নেই।”
রাস্তার ওপর গাছ ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে আশাশুনি ও কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেও। শ্যামনগরের খানপুর, চণ্ডিপুর, সদর, উত্তর বাঁধঘাটা, ইসমাইলপুর, হাইবাতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় বড় বড় গাছ উপড়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাছ সরাতে কাজ করছেন।
পটুয়াখালী
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে পটুয়াখালীতে দমকা হওয়ায় গাছ উপড়ে বসত ঘরের ওপর পড়ে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, রাতে দমকা হাওয়া শুরু হলে একটি রেইন্ট্রি ও একটি চাম্বল গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়লে চাপা পড়েন ওই বৃদ্ধ। তাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে পটুয়াখালীতে, সেই সঙ্গে দমকা বাতাস। নিরাপত্তার কারণে উপকূলীয় কয়েকটি উপজেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার মেঘনা নদীর তীরে ২৫টি ঘর বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মমিন জানিয়েছেন।
বাগেরহাট
বাগেরহাটের রামপালে ঝড়ের মধ্যে ঘরের উপর গাছ চাপা পড়ে সামিয়া খাতুন (১৫) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। রোববার বেলা পৌনে ১২টার দিকে উপজেলার ভরসাপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাকের বসতবাড়িতে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
নিহত সামিয়া একই উপজেলার দর্পনারায়ণপুর গ্রামের বাবুল শেখের মেয়ে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, বৃষ্টির মধ্যে ঝড়ো হাওয়ায় টিনের ঘরের উপর একটি মেহগনি গাছ উপড়ে পড়ে। ওই গাছের ভারে ঘরটি দুমড়ে মুচড়ে চাপা পড়ে একজন নিহত ও দুইজন আহত হন।
বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুল ইসলাম জানান, ঝড়ে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের ৭৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টিতে কমবেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্যোগ কবলিত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ৩২ হাজার। ঝড়ে এই জেলায় ৩৫ হাজার ৭৭৫টি ঘরবাড়ি আংশিক এবং আট হাজার ৭৮৮টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ে বেড়িবাঁধও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।। এই বাঁধ মেরামত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে চাল ও নগদ অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা খালেদ কনক।
রাস্তার উপর গাছ পড়ে জেলার তিনটি মহাসড়কে প্রায় চার ঘন্টা যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল বলে জানিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ।
তিনি বলেন, বাগেরহাটের মংলা খুলনা, বাগেরহাট খুলনা এবং সাইনবোর্ড আঞ্চলিক মহাসড়কের উপর বেশ কিছু গাছ পড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে আমরা তা কেটে সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করি।
বাগেরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন জানান, ঝড়ো হাওয়ার কারণে উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হলেও ঝড় তীব্রতা কমে যাওয়ার পর আবার সঞ্চালন শুরু হয়।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. নাহিদ উজ্জামান খান জানান, বলেশ্বর নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা এক থেকে দুই ফুট বেড়েছে।
ভোলা
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভোলায় ভোর রাতে শুরু হওয়া দমকা হাওয়া ও প্রবল বৃষ্টি সকালের পর কমতে শুরু করে। ঝড়ের প্রভাবে এই দ্বীপ জেলার চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, মনপুরা উপজেলার চর মোজাম্মেল, কলাতলির চর ও তজুমুদ্দিন উপজেলার চর জহিরুদ্দিনের নিন্মাঞ্চল ৩-৪ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়।
ঝড়ের প্রভাবে ভোলায় শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। এদের মধ্যে গুরুতর পাঁচজনকে চরফ্যাসন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে ভোলা সদরের ইলিশা এলাকায় মেঘনা নদীতে ২৪ জন জেলে নিয়ে একটি ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় ১০ জন জেলে জীবিত উদ্ধার এবং একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে ১৩ জন জেলে।
অন্যদিকে খেসারির আবাদ হয়েছে ৫৩৬ হেক্টর, যার ৯০ ভাগ সম্পূর্ণ আক্রান্ত এবং পান আবাদ হয়েছে ৫৩৬ হেক্টর, যার মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ১৩৪ হেক্টর। দুর্যোগ কবলিত ফসলের মধ্যে আমন ধান ১০ ভাগ, শীতকালীন সবজি ও ডাল ৯০ ভাগ এবং পান ২৪ ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ভোলা সদরের ভেলুমিয়া ইউনিয়নের কৃষক সিরাজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বেশিরভাগ ধান পানিতে তলিয়ে রয়েছে। অধিকাংশ হেলে পড়েছে। এখানে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ ক্ষয়ক্ষতির এই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। আগামী দুই দিনের দিনের মধ্যে জেলার ফসলের ক্ষয়ক্ষতির সুস্পষ্ট তথ্য দেওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
এদিকে জেলার লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলায় ঝড়ো বাতাসে ২২টি ঘর বিধ্বস্ত হয়ে ১৫ জন আহত এবং বেশকিছু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। শনিবার রাত ৯টার দিকে লালমোহনের পশ্চিম চর উমেদ, ধলিগৌর নগর ও লর্ডহাডিঞ্জ ইউনিয়ন এবং চরফ্যাসনের ওসমানগঞ্জ ও এওয়াজপুর ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। আহত কয়েকজনকে চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিক বলেছেন, যাদের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে তাদের ঘর নির্মাণ করার জন্য দুই বান্ডল টিন ও ৬ হাজার করে টাকা এবং চাল দেওয়া হবে। এছাড়া গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্যে নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
পিরোজপুর
বরগুনা
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে বরগুনায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। একটি ট্রলারসহ ১৫ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছে। ঘরচাপা ও গাছ পড়ে আহত ১৭ জনকে বরগুনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রোববার সন্ধ্যার পরে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সংবাদ সম্মেলন করে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়েছেন। তিনি জানান, সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের বানাই গ্রামের মোজাফ্ফর আলীর স্ত্রী হালিমা খাতুন শনিবার রাতে ডিএন কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের ছোট লবণগোলা গ্রামের মহিবুল্লাহ রোববার বিকাল ৪টার দিকে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত গাছের ডাল কাটছিলেন। এ সময় তিনি গাছ থেকে পড়ে আহত হলে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। সন্ধ্যার দিকে তিনি মারা গেছেন।
বরগুনা জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, শনিবার সকালে বঙ্গোপসাগরের নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে ১৫ জন জেলেসহ একটি মাছধরার ট্রলার নিখোঁজ হয়। রোববারও তাদের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
চাঁদপুর
চাঁদপুরে রোববার বিকেলে বয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া। এতে জেলার বিভিন্ন স্থানে বসতঘর ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঝড়ে চাঁদপুর শহরের হাসান আলী হাই স্কুল মাঠে নির্মিতব্য বিজয়মেলা মঞ্চের বেশ ক্ষতিসাধন হয়। এছাড়া সদর উপজেলার আশিকাটি, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বসতঘর ও গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অপরদিকে হাইমচর উপজেলার হালদারকান্দি গুচ্ছ গ্রামে ৩৮টি বসতঘর, নুর বাজার, মাঝির বাজার, ঈশানবালাসহ বিভিন্ন এলাকায় বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নীলকমল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন সরদার জানান, তার এলাকার মাঝির বাজার, মিয়ার বাজার, ঈশানবালাসহ বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
হাইমচর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সৈয়দ হাওলাদার জানান, হাওলাদার কান্দি গুচ্ছগ্রামের ৪০টি বসতঘরের মধ্যে ৩৮টির টিনের চাল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ওই এলাকায় আরও শতাধিক বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান জানান, তার এলাকায় ঝড়ে অর্ধশত বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিপাতের কারণে চাঁদপুরে এবার শীতকালীন সবজি ও আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরেজমিনে রোববার চাঁদপুর সদর উপজেলার গাছতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের সবজি নষ্ট হয়ে গেছে। লালশাক, পালংশাক, খীরা, বেগুন, মুলাসহ বিভিন্ন সবজি প্রচণ্ড বাতাসে কাঁত হয়ে জমিতে পড়ে রয়েছে। এছাড়া গত দুই দিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে শীতকালীন সবজি ও আমন ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গাছতলা এলাকার কৃষক মো. মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী বলেন, “আমি এবার পাঁচ একর জমিতে শীতকালীন বিভিন্ন ধরনের বীজ লাগিয়েছি। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুল-এর কারণে গত দুই দিন যাবত আমার শীতকালীন সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাছ মাটির সাথে মিশে গেছে। গাছের গোড়ায় পানি জমে ও বাতাসে ডালপালা ভেঙে গেছে।”
একই এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম পাটওয়ারী ও বিল্লাল হোসেন জানান, দুই দিনের বৃষ্টিতে ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। শীতকালীন সবজি ছাড়াও আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে জমিতে পানি জমে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. কবির হোসেন জানান, ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে শীতকালীন সবজি ও আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর সঠিক পরিমাণ এখনো নির্ণয় করা যায়নি।
গোপালগঞ্জ
গোপালগঞ্জে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।রোববার বেলা সোয়া ১২টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার খাটিয়াগড় এবং কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ি গ্রামে এক নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়।
নিহতরা হলেন- সদর উপজেলার খাটিয়াগড় গ্রামের মৃত বাবন কাজীর স্ত্রী মাঝু বিবি (৬৭) এবং কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ি গ্রামের সেকেল হাওলাদার (৭০)। দু’জনই গাছ চাপা পড়ে নিহত হন।
কোটালীপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, ঘুর্ণিঝড় বুলবুল বয়ে যাওয়ার সময় কোটালীপাড়ার বান্ধাবাড়িতে সেকেল হাওলাদার নামে এক বদ্ধ গাছচাপা পড়ে নিহত হন।
এছাড়া এ উপজেলায় শতাধিক ঘরবাড়ি, পোল্ট্রি খামার বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। মৌসুমী ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী বর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমান খান জানান, রান্না করার সময় রান্নাঘরের উপর গাছ পড়ে মাঝু বিবি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে।
ঝড়ে সদর উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০০ কাচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা ভেঙে ও উপড়ে পড়েছে।
বুলবুলের আঘাতে গোপালগঞ্জ শহরসহ জেলার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সড়কে গাছ উপড়ে পড়েছে। কিছু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভোর-রাত থেকে সব এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ঝড়ের দাপট খানিকটা কমে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও বিদ্যুৎ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের লোকজন মাঠে নামেন। বিকেল সোয়া ৫টার দিকে শহরে বিদ্যুৎ আসে।