বুলবুলের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনিপুর, কলকাতা এবং ওড়িশা রাজ্যের উপকূলীয় এলাকায় ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় বহু গাছ উপড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি। অনেক এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুই রাজ্যে ঝড়ে অন্তত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে এই ঘূর্ণিঝড়। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টা ঝড়টি পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করে।
বাংলাদেশ সময় রাত ২টায় ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র ছিল ভারতের ‘সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্কের’ ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ।
যেভাবে এগোচ্ছে বুলবুল
পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অতিক্রমের পর ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমশ দুর্বল হতে হতে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে এগিয়ে বাংলাদেশ সীমানায় প্রবেশ করে।
রোববার ভোর রাত সোয়া ৩টার দিকে ‘বুলবুল’ বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপকূল অতিক্রম করছিল বলে জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুলবুল দুর্বল হয়ে এখন সাতক্ষীরা উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করছে।”
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা এলাকার পল্লী চিকিৎসক আমানুল্লাহ ওই রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রে ‘ঠাঁই না পেয়ে’ নিজের বাসায় আছেন।
“এখন বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে।”
মংলা থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন ভোর রাত সোয়া ৫টায় জানান, সেখানে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় ভারতের আবহাওয়া বিভাগের বুলেটিনে বলা হয়, এ সময় ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৯৫ থেকে ১০৫ কিলোমিটার, যা দমকা হাওয়া আকারে ১১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ঝড়টি ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে এগোচ্ছিল।
এদিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক আয়শা খাতুন বলেন, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের টানা গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৯০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিনে।
এতে বলা হয়, উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোও এই মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে বুলেটিনে।
এছাড়া উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোও ৯ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় থাকবে।
কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করার সময় চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলা ও জেলার দ্বীপ-চরগুলোতে অতি ভারী বর্ষণের সঙ্গে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
এসব জেলার দ্বীপ, চর ও নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চাইতে ৫ থেকে ৭ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছাস বয়ে যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে শনিবার সারা দিন ও রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ বলছে, আগামী তিন ঘণ্টায় শক্তি আরও কমে বুলবুল ঘূর্ণিঝড়ে এবং তারপরের ছয় ঘণ্টায় নিম্নচাপে রূপ নেবে।
ভারতে ক্ষয়ক্ষতি
উপকূলে আঘাত হানার পর প্রায় ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটারজুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় তাণ্ডব চালায় ‘বুলবুল’। বহু জায়গায় ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘর। নষ্ট হয়েছে ফসলের ক্ষেত, দোকানপাট।
পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়, ঘর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় কলকাতায় বহু গাছ উপড়ে গেছে, নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে কলকাতা শহরের একটি নামকরা ক্লাবে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভারতের ওড়িষ্যায়ও ভারি বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে। এতে একজনের মৃত্যুর খবরও দিয়েছে তারা।
ঝড়ের কারণে কলকাতা বিমাবন্দরের সব কার্যক্রম ১২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাতে জানান, তার রাজ্যের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজার ৩৬৫ জনকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
ঘড়ের প্রভাব কেটে যাওয়ার পরেও যাদের ঘরে ফেরায় সমস্যা থাকবে, তারা ত্রাণ শিবিরে থাকতে পারবেন। পরে তাদের পুনর্বাসনে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবে সরকার।
ঝড় মোকাবেলার প্রস্তুতি
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠ সচিব মো. শাহ্ কামাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ৫ হাজার ৫৮৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে ২১ লাখ ৬ হাজার ৯১৮ জন লোককে নেওয়া হয়েছে।
“আমাদের টার্গেট ছিল ১৮ লাখ লোক সরাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাপক তৎপরতায় লোকজন নিরাপদে এসেছে, কাউকে জোর করা হচ্ছে না।
“২১ লাখ লোককে আশ্রয় কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নানা স্থাপনায় নিরাপদ আশ্রয়ে আনা হয়েছে।”
খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।
আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে এবং ২২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করছে।
উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম।
ঝড় এগিয়ে আসায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল শনিবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। শনিবার আরেক ঘোষণায় সোমবারের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। এ পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে তা পরে জানানো হবে।