ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ হাই কোর্টে বহাল

দুই শতাংশ অর্থ আগাম পরিশোধসাপেক্ষে খেলাপিদের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারকে বৈধ ঘোষণা করে তার মেয়াদ ৯০ দিন বাড়িয়ে দিয়েছে হাই কোর্ট।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2019, 11:04 AM
Updated : 4 Nov 2019, 06:12 AM

সেই সঙ্গে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ বাড়ানো হয়েছে আরও ৯০ দিন। তবে এসব ঋণ গ্রহীতাদের নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১২ সালের মাস্টার সার্কুলার অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

বিশেষ সুযোগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এক রিট আবেদনে দেওয়া রুল নিষ্পত্তি করে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের বেঞ্চ রোববার এই রায় দেয়।

পাশাপাশি ঋণ অনুমোদন ও আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা চিহ্নিত করে সম্ভাব্য সমাধানের জন্য নয় সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট। এ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাস্তবায়ন করবে।

আদালতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, শামীম খালেদ আহমেদ ও মুনীরুজ্জামান।

ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। রিট আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

‘সব ব্যাংকের ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা উচিত’ অভিমত দিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, অর্থ হচ্ছে অর্থনীতির রক্ত। এই রক্তের সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখা দরকার। হৃদপিণ্ড যেমন মানব দেহেরে রক্ত সঞ্চালনকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি অর্থনীতির রক্ত, অর্থাৎ অর্থের সঞ্চালন নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাংক।

“যদিও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারি, আত্মসাত, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটেছে। আবার এসবের হোতাদের ধরে বিচারের আওতায় আনতে সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশনও উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সেসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয়।”

রায়ের পর রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আদালত রায়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে যে ব্যাংকিং সেক্টরে যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, সেই রকম নয় জন ব্যক্তিকে দিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে।

“সেই কমিটি সরকারি বেসরকারি সকল ব্যাংকের যে দুর্বলতা, বিশেষ করে ঋণ পরিশোধ, ঋণ অনুমোদন, সংগ্রহে অনিয়মসহ এসব বিষয়ে কি কি করণীয়, উপায় বের করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন দেবে। আদালত বলেছে, ওই কমিটি যে প্রতিবেদন দেবে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা কার্যকর করবে।”

মনজিল বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের ভিত্তিতে কেউ যদি ঋণ পুনঃতফসিল করতে চায় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বোচ্চ তিন মাস সে সার্কুলারের মেয়াদ বাড়াতে পারবে।

এই পুনঃতফসিলের সুযোগ গ্রহণ করে পরবর্তীতে ঋণগ্রহীতা যদি নতুন ঋণ নিতে চান, তাহলে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট’ (বিআরপিডি) এর ‘মাস্টার সার্কুলার’ এর ৬(এ) বিধি অনুসরণ করতে হবে।

অর্থাৎ পুনঃতফসিলের সুযোগ গ্রহণ করা ঋণ গ্রহীতাকে নতুন ঋণ নিতে হলে বকেয়া টাকার ১৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে এবং ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো বা সিআইবিতে নাম পাঠাতে হবে।

ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, “আদালত কমিশন গঠনে সরকারের প্রতি কোনো নির্দেশনা দেয়নি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি কমিটি করতে বলেছে। ব্যাংকিং সেক্টরে কমিটির কাজ হচ্ছে- ব্যাংকিং সেক্টরে অনিয়ম কেন হয়েছে সেটি তদন্ত করে দেখে রিপোর্ট তৈরি করা।

“আর বাংলাদেশ ব্যাংক যে সার্কুলার দিয়েছিল (২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ খেলাপিদের পুনঃতফসিল করার সুযোগ) দিয়েছিল, সেটি অবৈধ হয়নি। বরং আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে দিয়েছে আদালত।”

মঞ্জুরুল হক বলেন, “এ রায়ের ফলে ব্যাংক খাতে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। বরং আরও ভাল হবে। আদালত বলেছে, সব ব্যাংকের ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা উচিত।”

ব্যাংক খাতে অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, সুদ মওকুফ সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত ও সুপারিশ প্রনয়নে কমিশন গঠন করতে গত ২৩ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট ৫ সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উকিল নোটিস দেয় মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ।

কারও কাছ থেকে নোটিসের জবাব না পেয়ে, আবার কারও জবাবে সন্তুষ্ট হতে না পেরে হাই কোর্টে ‘জনস্বার্থে’ এই রিট আবেদন করেন মনজিল মোরসেদ।

প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি ৩ দফা নির্দেশনা দিয়ে রুলসহ আদেশ দেয় বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্টে বেঞ্চ।

আদেশে গত ২০ বছরে এক কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি, ঋণের সুদ মওকুফ, অর্থপাচার ও অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন চায় আদালত।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বিবাদীদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠন করে সে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সিটি ব্যাংক এন এ বাংলাদেশের সাবেক সিইও মামুন রশিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিশন গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থপাচার রোধে কেন কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

কয়েক দফা সময় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপি বা অর্থপাচারকারীদের তালিকা আদালতে দাখিল না করলেও গত ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে নতুন সার্কুলার জারি করে।

সে সার্কুলারে ঋণ খেলাপিদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়।

রিটকারী পক্ষের সম্পূরক আবেদনে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করে। পরে গত ২৪ জুন স্থিতাবস্থা আরও দুই মাস বাড়ানো হয়। এর মধ্যে হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে সরকারের অর্থ বিভাগ।

সে আবেদনের শুনানি নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া স্থিতাবস্থার আদেশ শর্তসাপেক্ষে দুই মাসের জন্য স্থগিত করে দেয় আপিল বিভাগ।

আদালত বলে দেয়, কেউ এই সুবিধা নিলে দুই মাসের মধ্যে তিনি আর অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না।

সেই সঙ্গে রিটকারী পক্ষের আবেদনে হাই কোর্ট বেঞ্চ যে রুল দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি হবে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চে।

পরে গত ২৩ জুলাই ওই সার্কুলার নিয়ে রুল জারি করে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ। সার্কুলারটি কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

দীর্ঘ অবকাশের পর গত ১৩ অক্টোবর থেকে সেসব রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়ে গত ২৮ অক্টোবর শেষ হলে রোববার রায়ের জন্য রেখেছিল আদালত। সে অনুযায়ী এ রায় ঘোষণা করলো হাই কোর্ট।