রাইড শেয়ারিং: শর্ত পূরণ কবে জানে না কেউ

প্রায় দেড় বছর অপেক্ষার পরও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শর্ত পূরণ ছাড়াই রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দিয়েছে বিআরটিএ, ওই সব শর্ত কবে পূরণ হবে সে বিষয়েও স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2019, 03:50 PM
Updated : 2 Nov 2019, 04:19 PM

ভাড়া কীভাবে নেওয়া হবে সে বিষয়ে নীতিমালায় নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে কি না, তা নজরদারিও করা হচ্ছে না।

নীতিমালার কয়েকটি শর্ত পূরণ না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতির কথা বলছে সনদ পাওয়া রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো। অপরদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, কারিগরি দিক দিয়ে রাইড শেয়ারিং সেবা সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনও তৈরি হয়নি।

গণপরিবহনের সঙ্কটের ঢাকা শহরে ২০১৬ সালে রাইড শেয়ারিং সেবা চালু হওয়ার পর দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভাড়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে এই সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘রাইডশেয়ারিং সার্ভিস নীতিমালা ২০১৭’ অনুমোদন করে সরকার। ওই বছরের ৮ মার্চ থেকে এই নীতিমালা কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও শর্ত পূরণের অভাবে তা আটকে যায়।

পরে নীতিমালার কয়েকটি বিষয়ে ছাড় দিয়ে গত ১ জুলাই থেকে রাইড শেয়ারিং সেবা দাতা প্রতিষ্ঠান ও মোটরযানের তালিকাভুক্তির সনদ বা এনলিস্টমেন্ট সার্টিফিকেট ইস্যু করে বিআরটিএ। এরইমধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান এই অনুমোদন পেয়েছে।

এগুলো হল- পিকমি লিমিটেড, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড, ওভাই সলিউশনস লিমিটেড, চালডাল লিমিটেড, পাঠাও লিমিটেড, ইজিয়ার টেকনোলজিস লিমিটেড, আকাশ টেকনোলজি লিমিটেড, সেজেস্টো লিমিটেড, সহজ লিমিটেড, উবার বাংলাদেশ লিমিটেড, বাডি লিমিটেড ও আকিজ অনলাইন লিমিটেড।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উবার, পাঠাও, সহজ, ওভাই ও পিকমি যাত্রীসেবা দিলেও নীতিমালার বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে পারেনি তারা।

নীতিমালা অনুযায়ী রাইড শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনে এসওএস সুবিধা (জরুরি সেবাপ্রাপ্তি), পুলিশ কন্ট্রোলরুমকে সতর্কবার্তা পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, প্রতিটি রাইড পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা এবং কন্ট্রোল রুম প্রয়োজনে সরাসরি দেখতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।

রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের যাবতীয় তথ্যাবলী বাংলাদেশের মধ্যেই প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ করতে হবে, তথ্য কোনোভাবেই বাংলাদেশের বাইরে পাঠানো যাবে না- নীতিমালার এই শর্তটিও পালন করতে পারেনি কোনো প্রতিষ্ঠান।

এসব শর্ত অনতিবিলম্বে পূরণ করা হবে- এই অঙ্গীকার দিয়ে তালিকাভুক্তির আবেদন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এসব শর্ত কতদিনের মধ্যে পূরণ করা হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।

নীতিমালার শর্তগুলো কবে বাস্তবায়ন করা হবে জানতে চাইলে লিখিত জবাবে উবার বলেছে, রাইড শেয়ারিংয়ের সুবিধাগুলো বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কাজ করছে তারা।

“এসওএস ইন্টিগ্রেশন নিয়ে ৯৯৯-এর সাথে কাজ করছি, শীঘ্রই এটি বাস্তবায়িত হবে। উবার ইতোমধ্যে অ্যাপ্লিকেশনটির এসওএস বাটনে ৯৯৯ বিভাগের কন্ট্রোল রুমকে যুক্ত করেছে।”

দেশের মধ্যে তথ্য সংরক্ষণের বাধ্যবাধতার বিরোধিতা করে উবার বলছে, “আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই যে, উবার খুব উচ্চমানের তথ্য নিরাপত্তা পদ্ধতি অনুসরণ করে এবং তথ্য সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে সংরক্ষিত আছে কি না তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। যেহেতু উবারের মতো অ্যাপগুলো অন্যান্য দেশের নাগরিক এবং বাংলাদেশিরা একইভাবে ব্যবহার করছে তাই শুধু বাংলাদেশেই তথ্য সংরক্ষণ ও সঞ্চালন আমাদের সেবার মানের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং এটি অন্যান্য দেশের নাগরিকদের গোপনীয়তার উপরেও প্রভাব ফেলবে।”

শর্ত পূরণ কবে নাগাদ জানতে চাইলে ওভাই’র সহকারী ব্যবস্থাপক (রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) সৈয়দ ফখরুদ্দিন মিল্লাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারাও কারিগরি দিকগুলো ‘ঠিক করে রেখেছেন’।

“এসওএসসহ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের দিক থেকে আমরা তৈরি আছি। পুলিশের দিক থেকে যখন আমাদের অবকাঠামোগত সুবিধা দিতে পারবে তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমরা এই সেবা দিতে পারব। আর সার্ভারের বিষয়ে বিআরটিএকে অঙ্গীকার করা হয়েছে যে, তথ্যগুলো পাচার হবে না। দেশে যদি ভবিষ্যতে এসব সুবিধা সুলভ হয় তাহলে আমরা সার্ভার দেশেই নিয়ে আসার চেষ্টা করব।”

রাইড শেয়ারিং নীতিমালার তিনটি বিষয়ের সমন্বয় করবে পুলিশের ৯৯৯ সেবা বিভাগ। তবে এজন্য প্রয়োজনীয় অনেক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এখনও আনা হয়নি বলে পুলিশ সদরদপ্তরে ৯৯৯-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কবে এসব আনা হবে তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

“রাইড শেয়ারিং কোম্পানির অ্যাপে সেবাদানের যে লিংকআপ আছে সেটা আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এই ইন্টিগ্রেশন করার জন্য আমাদের সিস্টেমে কিছু কাজ এখনও বাকি আছে, প্রক্রিয়াধীন আছে। তাদের সিস্টেমের উপযোগী করার জন্য আমাদের যে যন্ত্রপাতি লাগবে সেগুলো বিদেশ থেকে কিনতে হবে। যেহেতু আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান, এগুলো কিনতে হলে আগে বাজেটের ব্যাপার আছে। আমাদের অথরিটি আমাদের বাজেট দেবে, সেটা প্রকিউর করার জন্য আমাদের অনুমোদন দেবে। এরপর আমি টেন্ডার কল করব। এটা কতদিন লাগবে বলা যাচ্ছে না।

“যন্ত্রপাতি এনে ইনস্টল করে পরে তাদের সঙ্গে আমরা বৈঠকে বসব।”

নিজেদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় শর্ত পূরণের বিষয়ে রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বিআরটিএর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে থাকায় আমাদের সফটওয়্যারে কিছু জটিলতা আছে। সব কিছু কমপ্লিট করার পরে, যেমন ১৫ বা ২০টা কোম্পানিকে অনুমোদন দিলাম। অথবা এক লাখ বা দেড় লাখ গাড়িকে তালিকাভুক্ত করলাম, তখন আমরা আর তাদের ছাড় দেব না।

“তখন যেই তারিখে শেষ (শর্ত পূরণ) হওয়ার কথা, সেই তারিখেই শেষ করতে হবে।”

ভাড়া দেখার কেউ নেই

রাইড শেয়ারিং নীতিমালায় কোম্পানিগুলোকে ২০১০ সালের ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা অনুযায়ী ভাড়া রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মটরসাইকেলের ভাড়া নিয়ে কিছু বলা হয়নি।

ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা অনুযায়ী, ইকোনমি ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ৫০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারের জন্য ১২ টাকা ভাড়া আদায়ের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া প্রতি দুই মিনিটের জন্য ৩ টাকা ওয়েটিং চার্জ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

২০১৪ সালের এপ্রিলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়া সংশোধন করে সরকার। এ সময় প্রথম দুই কিলোমিটার ৮৫ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ৩৪ টাকা, কল চার্জ ২০ টাকা এবং প্রতি দুই মিনিটের ওয়েটিং চার্জ ৮ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

এরপর ২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য অটোরিকশার ভাড়া ৪০ টাকা, পরবর্তী প্রতি কিলোমিটার ১২ টাকা, ওয়েটিং চার্জ প্রতি মিনিট দুই টাকা এবং সর্বনিম্ন ভাড়া ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

ভাড়া নিয়ে রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কোনো নজরদারি আছে কি না জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক লোকমান হোসেন মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্তমানে বিআরটিএর লোকবলের অভাবে কারণে ‘এটা করা কঠিন’।

“আমাদের আইসিটির লোকবল নাই। আমরা সেন্ট্রাল ই-মনিটরিং সিস্টেম করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু সেটা করা অনেক সময়ের ব্যাপার।”

বিআরটিএর এই কর্মকর্তা বলেন, “রাইড শেয়ারিং পৃথিবীর সব দেশেই ইনফরমাল সেক্টর। এ কারণে অন্য কোনো দেশের মডেলও আমরা পাইনি। আমরা তাও নীতিমালা করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনেছি। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।”

ভাড়া নিয়ে কোনো সেবাগ্রহীতা অভিযোগ করলে সে বিষয়ে বিআরটিএ ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।

“প্রত্যেকটি রাইড শেয়ারিংয়ের ওয়েবসাইটে কমপ্লেইন বক্স আছে। কেউ অভিযোগ করলে তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়। ফলোআপটা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আমাদের জানাবে এমনটা তাদের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে। কিন্তু সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যদি সুরাহা না করে সেক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা আমাদের কাছে সরাসরি অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”