মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন দুরন্ত শিশুরা

বিকেলের মিষ্টি আলোয় যে রঙিন বেলুন ঘিরে আগ্রহ-উত্তেজনায় উচ্ছল ছিল শিশুর দল, সেই বেলুন ফোলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে শেষ হল তাদেরই প্রাণ।

লিটন হায়দারও কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2019, 06:15 PM
Updated : 30 Oct 2019, 06:34 PM

বুধবার বিকাল ৪টার আগে ঢাকার মিরপুরের রূপনগরে শিয়ালবাড়ি বস্তির কাছে রাস্তার উপরে এই বিস্ফোরণে মারা গেছে ছয়টি শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৭ জন, যাদের অধিকাংশই শিশু।

নিহত শিশুদের একজন রুবেল (১১) বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত ওই বস্তির ঘরে। রিকশাচালক বাবার কাছে বেলুনের বায়না ধরে ধমক খেয়ে ঘরে ফিরলেও পরে আবার বেরিয়ে বেলুনের কাছে যায় সে।

রুবেলের খালা করিমজান জানান, রুবেল স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। তারা চার ভাই ছিল। গত বছর রুবেলের ছোটজন জিয়াদ (৯) ভোলায় গ্রামের বাড়িতে পুকুরে ডুবে মারা যায়।

রুবেল এখন শুধুই ছবিতে

খালা জানান, রুবেলের বাবা নূর ইসলাম দুপুরে ভাত খেয়ে বের হওয়ার সময় তার কাছে বেলুন কিনে দেওয়ার বায়না করে সে। বাবার পিছে পিছে বেরও হয়েছিল। কিন্তু বাবা ধমক দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলে পরে আবার বের হয়।

এ সময় তিনিও কাছেই ছিলেন করিমজান বলেন, বস্তির বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। পেছন ঘুরে বাসার ভেতর ঢোকার সময় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনতে পান।

“ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি সেই বিভৎস দৃশ্য। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো না। ২০-২২ জনের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রত্যেকের শরীরে রক্ত। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারো নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে গেছে। আবার কারও শরীর বিচ্ছিন্ন। সেই সাথে আহাজারি আর চিৎকার। এদের প্রায় সবাই শিশু।”

এরপরেই সবাই ছুটাছুটি শুরু করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “রুবেলকে তো এখানেই দেখলাম। কই গেল ছেলেটা বলেই খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পেলাম।

“ওকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল তখন তার শরীর দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পেট থেকে নিচের দিকটা একদিকে পড়ে আছে, আর উপরের অংশ আরেক দিকে। বাম হাত আবার আরেক দিকে।”

রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকায় বুধবার গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুসহ কয়েকজন হতাহতের পরে সেখানে ভিড় করে মানুষ।

বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো ১০ বছরের নুপুরের ঢাকা আসা চিকিৎসার জন্যে। দেড় বছর আগে গ্রামের বাড়ি ভোলায় গোসল করতে গিয়ে নাকি তার পেটে জোঁক চলে যায়। এরপরে অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকায় চলে আসেন মা সুরমা বেগম। দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে ওই বস্তিতে উঠেছিলেন তিনি।

স্বামী অত্যাচার করায় তাদের মধ্যে অলিখিত বিচ্ছেদ চলছে জানিয়ে সুরমা বলেন, বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করে মেয়ের চিকিৎসা করান।পরে দুই মেয়েকে স্কুলেও ভর্তি করে দেন।

তিনি বলেন, তার চার বছরের ছেলে রহমানকে নূপুরই দেখাশোনা করত।

“বাসায় না পেয়ে ভাইকে খুঁজতে বের হয়েছিল নূপুর। কিন্তু রহমান পাশের এক ঘরে ছিল, সেটা সে জানত না। বাইরে অন্য শিশুদের সাথে থাকতে পারে ভেবে বেলুন বিক্রেতার কাছে যায় নুপুর।”

পরে সেখানে বিস্ফোরণের হতাহতের কথা শুনতে পেয়েই ছুটে আসেন সুরমা বেগম। সেখানে ওই চিত্র দেখে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বলে জানান সুরমার স্বজন মেজবাহ।

তিনি বলেন, “খুব কষ্টে সংসার চালাতেন সুরমা। বাসা-বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের স্বাবলম্বী করাই তার লক্ষ্য ছিল।”

ঢাকার রূপনগরে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত শিশুদের স্বজনের আহাজারি।

তরুণ নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বিকালে পাশেই একট টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন তিনি। বেলুনের ভ্যান ঘিরে শিশুদের ছুটাছুটি দেখছিলেন।

“কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বিকট শব্দ। ছুটে গিয়ে যে দৃশ্য দেখতে হয়েছে তা বর্ণনার মতো না। যারা নিশ্চিত মারা গেছে তাদের ঢাকা দিয়ে রাখা হয়। আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।”

এ ঘটনায় আহত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের অন্তত চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন মো. আলাউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চারজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। একজনের নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে গেছে, একজনের ডান হাত উড়ে গেছে, দুইজনের মুখমণ্ডল থেতলে গেছে।”

এই আহতদের একজন ২৬ বছরের জান্নাতের ডান হাত কনুই থেকে উড়ে গেছে। তার দেবর মনির হোসেন পাশেই একটি প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করছিলেন। খবর পেয়েই ছুটে আসেন তিনি।

“এসে দেখি ভয়ানক দৃশ্য। কারও নাড়ি-ভুড়ি বের হয়ে গেছে। কারও মাথা থ্যাতলানো, কারও পুরো শরীর রক্তাক্ত। পাশেই ভাবি পড়ে আছেন ডান হাতের কনুই পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন। ”

জিয়ারত মিয়া নামে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনাস্থল থেকে একশ গজের মতো দূরে একটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ বিকট শব্দে দৌঁড়ে এসে দেখেন কয়েকজন শিশু পড়ে আছে, আবার কতগুলো শিশু চিৎকার করছে।

তিনি বলেন, “বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছে, তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। এত শিশু এভাবে পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে অন্য কিছু ভেবেছিলাম।”

এই বিস্ফোরণে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন মো. সোহেল (২৫) নামে এক রিকশাচালক। তার চোখে লেগেছে।

ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাছেই একটি ইলেক্ট্রিক দোকানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

“আমি দেখছি পাশে একজন বেলুনওয়ালা তার গ্যাস সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হওয়ার পর আবার গ্যাস তৈরি করছিল। তখন একজনকে বলতে শুনেছি, এভাবে গ্যাস তৈরি করলে বিস্ফোরণ হবে। তার কিছুক্ষণ পরই বিস্ফোরণ হয়।”