বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে দেওয়া বক্তব্যে আসামিদের কেউ কেউ জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করলেও হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
সাক্ষ্যগ্রহণের পর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেছিলেন, তারা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন।
তিন বছর আগের ঝড় তোলা ওই ঘটনায় বিচার শুরুর একাদশ মাসে এসে গত ২৭ অক্টোবর শেষ হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ। এরপর আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য নেওয়া হল।
বুধবার আট আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের পর ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান আগামী ৬ নভেম্বর মামলার যুক্তিতর্কের জন্য দিন রাখেন।
যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে হবে রায়; যা এই বছরই হবে বলে আশা করছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা।
হামলার সময় এবং পরে জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহতদের বাদ দিয়ে গ্রেপ্তার ৮ আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
কারাগারে থাকা এই আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।
অন্য হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি জাহাঙ্গীরের
বুধবার আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন লিখিত বক্তব্য জমা দেন আসামিরা। এর মধ্যে মুখেও বক্তব্য রাখেন গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধী। তাতে তিনি রংপুরে কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন।
ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান আসামি জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শোনেন।
হলি আর্টিজানে হামলার সময় বাইরে পাহারায় ছিলেন বলে এর আগে স্বীকার করলেও আত্মপক্ষ সমর্থনে এসে দোষ অস্বীকার করেন জাহাঙ্গীর।
উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ‘নব্য জেএমবি’র সদস্য জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি আইএসের সদস্য।”
পুলিশের ভাষ্যে, এই জাহাঙ্গীর উত্তরাঞ্চলে সব কটি জঙ্গি হামলায় নেতৃত্বদাতা। রাজীব গান্ধী ছাড়াও সুভাস, শান্ত, টাইগার, আদিল, জাহিদ, ওমরসহ বিভিন্ন ছদ্ম নাম নিয়ে জঙ্গি কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন তিনি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পশ্চিম রাঘবপুর গ্রামের ওসমান আলীর ছেলে জাহাঙ্গীরকে গত ১৪ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রংপুরে জাপানের নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা, টাঙ্গাইলের দর্জি নিখিল হত্যা, পাবনার পুরোহিত নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে হত্যা, রংপুরের মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা, কুষ্টিয়ায় হোমিও চিকিৎসক সানাউর হত্যা, পঞ্চগড়ে পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর হত্যা, দিনাজপুরের হোমিও চিকিৎসক ধীরেন্দ্রনাথ হত্যা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর হত্যাসহ ২২টি হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় জাহাঙ্গীর ওরফে রাজীব গান্ধীকে আসামি করা হয়।
আদালতে জাহাঙ্গীর বলেন, ২০০২ সালে জেএমবিতে যোগ দেন তিনি।
“২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় খেলাফত ঘোষণা করা হলে তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে বাইয়াত (আনুগত্য প্রদান করা) পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করি উত্তরবঙ্গে।”
গুলশান হামলায় রোহন, উজ্বল ও পায়েল (হামলার পর কমান্ডো অভিযানে নিহত) সরাসরি জড়িত ছিলে বলে আদালতে জানান তিনি।
জাহাঙ্গীরের ভাষ্যে, হামলার আগের মাসে ২০১৬ সালের ২০ মে তামিম চৌধুরী (নিহত শীর্ষ জঙ্গি নেতা) একটি অ্যাপের মাধ্যমে দেখা করার বার্তা দিলে সারোয়ার, বাশারুজ্জামান চকলেট, মারজান, নাঈম ও তারেকের সাথে বৈঠকে যোগ দেন তিনি।
“এ সময় তামিম সবাইকে বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দেন। তামিম সারোয়ারকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতে বলে। চকলেট তখন নাঈম ও তারেককে অস্ত্র ও বোমা সরবরাহের দায়িত্ব দেয়।”
জাহাঙ্গীর প্রশাসনের নজরদারি থেকে গা ঢাকা দিতে তাকে তামিম বসুন্ধরায় এক বাসায় নিয়ে যান বলে দাবি করেন তিনি।
ওই বাসাটি ছিল সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী (পরে নিহত) এবং তার স্ত্রী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেইভ দ্য চিলড্রেনের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা ওরফে আশার।
আজিমপুরে অভিযানে তানভীর কাদেরী নিহত হন। ফাতেমা গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন কারাগারে।
জাহাঙ্গীরের ভাষ্যে, “বাসায় গিয়ে আমি মানিক, তামিম চৌধুরী, তানভির কাদেরী ও তার দুই ছেলেসহ হলি আর্টিজান হামলার পাঁচজনকে দেখতে পাই। তার একদিন পর ওই বাসায় মারজানও আসে।”
তামিমসহ অন্যান্যরা হলি আর্টিজান হামলা নিয়ে অন্য ঘরে বৈঠক করতেন বলে বিচারককে জানান জাহাঙ্গীর।
“আমার জানা মতে, মেজর জাহিদ ও সারোয়ার জাহান ওই তিনজনকে প্রশিক্ষণ দেন।”
হামলার আগে ২৭ জুন পর্যযন্ত কোথায় হামলা হবে তা তামিম, সারোয়ার, মারজান ছাড়া আর কেউ জানত না, দাবি করেন জাহাঙ্গীর।
“তামিমকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘১ জুলাই চলে যাবেন’।”
জাহাঙ্গীরের বক্তব্য অনুযায়ী, হামলার দিন সকাল ৮টায় পায়েল জানায়, ঢাকায় হামলা হবে। হামলার পর ৩ জুলাই তামিম ৫০ হাজার টাকা দিয়ে তাকে হামলাস্থল রেকি করতে পাঠিয়েছিল।
জাহাঙ্গীর দাবি করেন, এরপর দলের দাওয়াতি বিভাগের প্রধান রজবকে আনতে গিয়ে ১০ জুলাই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তিনি। কিন্তু পুলিশ ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তাকে আটকের খবর গোপন রেখেছিল।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্য আসামিদের নাম তিনিই পুলিশকে জানিয়েছিলেন বরে দাবি করেন জাহাঙ্গীর।
আদালতে জাহাঙ্গীরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন।
‘আমি সেই মিজান নই’
আসামি মিজান ওরফে বড় মিজান দাবি করেছেন, তিনি একজন মাছ ব্যবসায়ী মিজান। নামে মিলের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “আমি মাছের ব্যবসা করতাম। আমি সেই মিজান নই, আমি মাছ ব্যবসায়ী মিজান। শুধু নামের কারণে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।”
বগুড়ার বাসিন্দা মিজানের দাবি, ঘটনার পর ওই জেলার পুলিশ তাকে আটক করলেও প্রথমে ছেড়ে দিয়েছিল। এর কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে।
অন্য ছয় আসামির কেউ মৌখিক বক্তব্য দেননি, তারা শুধু লিখিত বক্তব্য জমা দেন।
আসামিদের কেউ কেউ ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদনও জানান।
রায় এই বছরে হওয়ার আশা
যুক্তিতর্ক শেষ হওয়ার পর এই বছরই মামলার রায় হবে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ তরুণের সশস্ত্র হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
নজিরবিহীন ওই হামলা দেশে জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক বিস্তারের মাত্রা স্পষ্ট করে তোলে। বড় ওই ধাক্কা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির গত বছরের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
চিহ্নিত বাকি ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। নিহতদের মধ্যে হামলাকারী ৫ তরুণ রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েলও রয়েছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।