খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ: হাই কোর্টের রায় ৩ নভেম্বর

ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলার বৈধতা পাবে কি না- ৩ নভেম্বর সে সিদ্ধান্ত দেবে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2019, 04:45 PM
Updated : 28 Oct 2019, 04:45 PM

আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠন এবং ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের বিশেষ সুযোগের বৈধতা প্রশ্নে আদালত যে রুল জারি করেছিল, সেদিন সে বিষয়ে রায় দেবে আদালত।

সোমবার রুলের ওপর সব পক্ষের শুনানি শেষে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ রায়ের জন্য ৩ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেয়।

আদালতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ছিলেন আজমালুল হোসেন কিউসি. বাংলাদেশ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ছিলেন শাহ মঞ্জুরুল হক ও পলাশ চন্দ্র রায়। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ ও নীতি বিভাগের (বিআরপিডি) যুগ্ম পরিচালক মাহমুদুন নবী শুনানিতে আইনজীবীর মাধ্যমে একটি হলফনামা দাখিল করেন। ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয় সেখানে।

হলফনামায় বলা হয়, “খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা না হলে ঋণ গ্রহীতাদের শিল্প, কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে, কর্মচারীরা বেকার হয়ে পরবে, দেশের উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়বে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনস্বার্থে ওই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।”

‘স্বেচ্ছা ঋণখেলাপিরা’ ওই বিজ্ঞপ্তির অধীনে কোনো সুবিধা পাবে না দাবি করে হলফনামায় বলা হয়, ‘ভুল’ ব্যক্তিকে সুবিধা দিয়ে ওই বিজ্ঞপ্তির অপব্যবহারের কোনো সুযোগ এখানে নেই।

“অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বা অনিবার্য কারণে যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন, এ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ঋণখেলাপি এবং নিয়মিতভাবে ঋণ পরিশোধকারীদের মধ্যে এ বিজ্ঞপ্তি কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করবে না।

“অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের বাণিজ্য খাতে, বিশেষ করে জাহাজ ভাঙা শিল্পে যারা বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অধিকাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছেন। যার ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণখেলাপির সংখ্যা বেড়ে গেছে।

“এসব বিচেনায় অর্থ মন্ত্রণায় গত বছরের ২০ জুন ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ ব্যাংক বিজ্ঞপ্তি জারি করে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী পলাশ চন্দ্র রায় হলফনামা দাখিল করে বলেন, জনস্বার্থ বিবেচনায় এ বিষয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করার এখতিয়ার আবেদনকারীদের নেই।

অন্যদিকে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ব্যাংক খতের দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা দূর করতে কমিশন গঠনের ওপর যুক্তি দেন শুনানিতে। কমিশনের কার্যপরিধি নিয়ে ৯ দফা সুপারিশও তিনি দাখিল করেন।

মনজিল মোরসেদ বলেন, বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), সিপিডিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেটা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

এসব সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের বিভিন্ন দুর্বলতা ও সমস্যা দূর করার সুপারিশ করে এলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাই জনস্বার্থে রিট আবেদন করে কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।

ব্যাংক খাতে অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, সুদ মওকুফ সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত ও সুপারিশ প্রনয়নে কমিশন গঠন করতে গত ২৩ জানুয়ারি সংশ্লিষ্ট ৫ সচিবসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে উকিল নোটিস দিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ।

কারও কারও নোটিসের জবাব না পেয়ে, আবার কারও কারও জবাবে সন্তুষ্ট হতে না পেরে হাই কোর্টে ‘জনস্বার্থে’ এই রিট আবেদন করেন মনজিল মোরসেদ।

প্রাথমিক শুননি নিয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি ৩ দফা নির্দেশনা দিয়ে রুলসহ আদেশ দেয় বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্টে বেঞ্চ।

আদেশে গত ২০ বছরে এক কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি, ঋণের সুদ মওকুফ, অর্থপাচার ও অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদন চায় আদালত।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে আর্থিক দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বিবাদীদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা বন্ধে কমিশন গঠন করে সে কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, সিটি ব্যাংক এন এ বাংলাদেশের সাবেক সিইও মামুন রশিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে কমিশন গঠনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থপাচার রোধে কেন কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দুই সচিব, আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

কয়েক দফা সময় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপি বা অর্থপাচারকারীদের তালিকা আদালতে দাখিল না করলেও গত ১৬ মে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে নতুন সার্কুলার জারি করে।

সে সার্কুলারে ঋণ খেলাপিদের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়।

রিটকারী পক্ষের সম্পূরক আবেদনে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করে। পরে গত ২৪ জুন স্থিতাবস্থা আরও দুই মাস বাড়ানো হয়। এর মধ্যে হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে সরকারের অর্থ বিভাগ।

সে আবেদনের শুনানি নিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া স্থিতাবস্থার আদেশ শর্তসাপেক্ষে দুই মাসের জন্য স্থগিত করে দেয় আপিল বিভাগ।

আদালত বলে দেয়, কেউ এই সুবিধা নিলে দুই মাসের মধ্যে তিনি আর অন্য কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন না।

সেই সঙ্গে রিটকারী পক্ষের আবেদনে হাই কোর্ট বেঞ্চ যে রুল দিয়েছিল, তার নিষ্পত্তি হবে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চে।

পরে গত ২৩ জুলাই ওই সার্কুলার নিয়ে রুল জারি করে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ। সার্কুলারটি কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

দীর্ঘ অবকাশের পর গত ১৩ অক্টোবর থেকে সেসব রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়ে সোমবার শেষ হয়।