সাক্ষ্য দিলেন অভিজিতের বাবা

সন্তান হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিলেন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Oct 2019, 08:31 AM
Updated : 28 Oct 2019, 03:59 PM

কয়েকটি তারিখ অনুপস্থিত থাকার পর বয়সের ভারে ন্যুব্জ শোকার্ত এই বাবা সোমবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হন।  

অভিজিতের ওপর হামলার খবর পাওয়ার পর হাসপাতালে ছুটে যাওয়া, সেই রাতেই ছেলের মৃত্যু এবং পরদিন থানায় মামলা করার বিবরণ তিনি সাক্ষ্যে তুলে ধরেন।

পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অজয় রায়কে।

প্রবাসী লেখক অভিজিৎ রায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে বেরিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর এ মামলা দায়ের করেন তার বাবা।

চার বছর পর গত ১৩ মার্চ ছয় জঙ্গিকে আসামি করে বহুল আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

আদালত গত ১ অগাস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরুর আদেশ দেয়। সে অনুযায়ী ১১ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হয় শোকগ্রস্ত অজয় রায়ের অনুপস্থিতির কারণে। 

সাধারণত মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় বাদীর জবানবন্দি গ্রহণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সন্তান হারানোর বেদনা নতুন করে মনে জাগাতে চান না বলে অধ্যাপক অজয় রায়, সাক্ষ্য দিতে আদালতে যেতে চাইছিলেন না।

কয়েকটি তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সোমবার সকাল ১০টার দিকে স্কুলশিক্ষক ছোট ছেলে অনুজিত রায়কে সঙ্গে নিয়ে অজয় রায় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের পঞ্চম তলায় সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালের এজলাসে আসেন।

কিন্তু দুপুরে খবর আসে, এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক  মো. মজিবুর রহমানের নিজের ছেলে অসুস্থ ।তিনি আদালতে আসতে পারছেন না।

তখন সিদ্ধান্ত হয়, ভারপ্রাপ্ত বিচারক হিসেবে ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক জেসমিন আরা বেগম গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার সাক্ষ্য শুনবেন।

অশক্ত অজয় রায়কে তখন চেয়ারে তুলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরানো ভবনের দ্বিতীয় তলায় ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বসানো হয় বিচারকের ডায়াসের কাছে একটি চেয়ারে।

কিছুক্ষণ পর বিচারক তার আসন নেন। কিন্তু আদালতে কোনো স্পিকার বা মাউথপিস না থাকায় অজয় রায়কে বসানো হয় বিচারকের ডায়াসে বিচারকরে পাশে।

এই মামলার ছয় আসামির মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া এবং আকরাম হোসেন ওরফে হাসিব ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে আবদুল্লাহ পলাতক।

উগ্রপন্থি ব্লগার শফিউর রহমান ফারাবী এবং আনসারুল্লাহর জঙ্গি মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার, আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস্ শুনানির সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।

জবানবন্দি

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরে মামলার বাদী ও প্রথম সাক্ষী অজয় রায় বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে আমি আমার ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। ডাক্তার বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু রাত ১০টার দিকে সে মারা যায়।

“আর অভিজিতের আহত স্ত্রী ফাহমিদা বন্যাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় গিয়ে হত্যা মামলা করি।”

সাক্ষ্য দেওয়ার সময় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল বৃদ্ধ অজয় রায়ের। এক পর্যায়ে বিচারক মামলার এজাহার দেখিয়ে জানতে চান, সেটি তার কিনা। অজয় রায় নিজের সই শনাক্ত করে এজাহারটি তার নিজের লেখা বলে জানালে সেখান থেকে তার বক্তব্য নথিভুক্ত করেন বিচারক।

এরপর অজয় রায় বিচারকের উদ্দেশে বলেন, “আমি তো অসুস্থ, আমার আসা কষ্টকর। আজ আমার সাক্ষ্য শেষ হবে তো?”

বিচারক তখন বলেন, “হ্যাঁ আজকে আপনার শেষ হয়ে যাবে।”

এরপর আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবের আইনজীবী এমএবিএম খায়রুল ইসলাম লিটন এরপর অজয় রায়কে জেরা শুরু করেন।

জেরা

আইনজীবী লিটন জেরায় অজয় রায়কে জিজ্ঞেস করেন, ঘটনার সময় তিনি কোথায় ছিলেন? উত্তরে অভিজিতের বাবা বলেন, তিনি বাসায় ছিলেন।

ঘটনার আগে ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী নামে কেউ (বুয়েট শিক্ষক) ফোন করে অভিজিৎকে ডেকেছিল কিনা জানতে চাইলে অজয় রায় বলেন, তার মনে নাই।

ফারসীম মান্নান চা খাওয়ার জন্য অভিজিৎকে ডেকেছিলেন কিনা- এই প্রশ্নে অজয় রায় বলেন, “হ্যাঁ।”

ফারসীম মান্নান ও আসিফ লেখক অভিজিতের স্ত্রী বন্যার বন্ধু কিনা জানতে চাইলে অজয় রায় বলেন, তিনি জানেন না।

আইনজীবী প্রশ্ন করেন, ফারসীম মান্নান ‘থ্রেট করে’ অভিজিৎকে মেসেজ দিয়েছিলেন কিনা। উত্তরে অজয় রায় বলেন, “হ্যাঁ।”

অভিজিৎকে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে ইরমান এইচ সরকার ও বরকত নামে দুজন গিয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে অজয় রায় বলে, হ্যাঁ, তারা সেখানে গিয়েছিলেন।

অভিজিৎ হাসপাতালে কিছু বলেছিলেন কিনা- জানতে চান আইনজীবী।

এ সময় অজয় রায় বলেন, “আমি যখন হাসপাতালে গিয়ে অভিজিৎকে দেখি তখন সে অচেতন ছিল, কথা বলতে পারেনি।”

অভিজিৎ ধর্ম ও রসুলের বিরুদ্ধে কিছু লিখতেন কিনা- এ প্রশ্ন করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।

উত্তরে অজয় রায় বলেন, “আমার ছেলে ধর্মের বিরুদ্ধে, রাসুলের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতো- এটা ঠিক না।”

এ মামলার আরেক আসামি শফিউর রহমান ফারাবী কোনো আইনজীবী নিয়োগ করেননি জানিয়ে নিজেই জেরা করেন।

পরে পলাতক আসামি জিয়াউল হক ওরফে জিয়া এবং আকরাম হোসেনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী (স্টেট ডিফেন্স) মোহাম্মদ জাকির হোসেন মামলার বাদীকে জেরা করেন। 

মনমতো উত্তর না পাওয়ায় তিনি একই প্রশ্ন বার বার করতে থাকেন অজয় রায়কে।

আইনজীবী জানতে চান, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কিনা। অজয় রায় উত্তরে বলেন, পুলিশের লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

জাকির প্রশ্ন করেন- অভিজিতের প্রকৃত খুনি কারা- তা তার বাবা জানেন কি না। অজয় রায় বলেন, “না।”

এ সময় ‘প্রকৃত আসামি’ অর্থ কি- তা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বোঝাতে থাকলে অজয় রায়ের মুখ থেকে একই উত্তর আসে।

অজয় রায়ের সাক্ষ্য শেষে মাসুদুর রহমান ও মো. সেলিম নামে আরও দুজন জব্দ তালিকার সাক্ষ্য দেন।

পরে বিচারক জেসমিন আরা বেগম ১৮ নভেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ঠিক করে দেন।

উদ্ধত ফারাবী

অজয় রায় দুপুরে যখন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইবুনালের এজলাসে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সেখানে চার আসামিকে হাজির করে পুলিশ।

তাদের মধ্যে ফারাবী এক সময় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় উদ্ধত ভঙ্গিতে ইশরায় অজয় রায়কে ডাকতে থাকেন। ফারাবীকে সে সময় কিছুটা উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

তবে সেখানে উপস্থিত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অজয় রায়কে ওই আসামির সঙ্গে কথা না বলার পরামর্শ দেন।

পরে অজয় রায় যখন বাদী হিসেবে তার জবানবন্দি শেষ করলেন, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ফারাবী বিচারকের উদ্দেশে বলতে থাকেন, “আমার কোনো আইনজীবী নেই। আমার স্টেপ মাদার আমার জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগ দেন নাই। আমার ফ্যামলির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নাই। আমি নিজেই জেরা করব। অভিজিৎতো আল্লাহ রাসুলের বিরুদ্ধে মুক্তমনায় লিখেছে। কি বিষয়ে লেখালেখি করতেন?  বলতে পারবেন? “

এ সময় আসামি মো. আবু সিদ্দিক সোহেলের আইনজীবী এম এ বিএম খায়রুল ইসলাম লিটনের হস্তক্ষেপে শান্ত হন উত্তেজিত ফারাবী। 

প্রধান কৌঁসুলি কেন নেই

সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীকে সম্প্রতি ‘কর্তব্যে অবহেলার জন্য’ অব্যাহতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়।

সে কারণে সোমবার এ মামলা পরিচালনা করেন রাষ্ট্রপক্ষের কনিষ্ঠ আইনজীবী গোলাম ছারোয়ার খান জাকির।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু কেন এ মামলায় থাকছেন না- সেই প্রশ্ন করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেক বলেন, “জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বয়সে জ্যেষ্ঠ হলেও কর্তব্যে অবহেলার কারণে এমনেই বাদ পড়তেন। তার রেপুটেশন ভাল ছিল না। আজকে আমার কোমর ব্যথা বলে আদালতে উপস্থিত থাকতে পারিনি।

“গোলাম ছারোয়ার খান জাকির কনিষ্ঠ আইনজীবী হওয়ায় এবং অভিজ্ঞতা কম থাকায় আমি সামনের তারিখগুলোতে এ মামলার প্রসিকিউশনে উপস্থিত থাকব।”

‘আসবেন না’ বন্যা

বইমেলা থেকে ফেরার সময় অভিজিতের ওপর যখন হামলা হয়, চাপাতির আঘাত ঠেকাতে গিয়ে এক হাতের বুড়ো আঙুল হারান তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।

অভিজিতের ছোট ভাই অনুজিৎ রায় আদালতপাড়ায় সাংবাদিকদের বলেন, বন্যা এখন যুক্তরাষ্ট্রে। তার দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।

“এদেশে তো বিচার নেই। আমরাই এদেশে পুরোপুরি নিরাপদ না। অভিজিতের স্ত্রী কীভাবে এদেশে থাকবে?”

পুরনো খবর