গুলশান হামলার মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মামলায় বিচার শুরুর একাদশ মাসে এসে শেষ হল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2019, 02:23 PM
Updated : 27 Oct 2019, 03:29 PM

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩ ডিসেম্বর মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের জবানবন্দি নেওয়ার মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছিল।

তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবিরকে জেরার মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হল সাক্ষ্যগ্রহণ। গত ১৭ অক্টোবর জবানবন্দি দেওয়ার পর তাকে জেরা করে আসছিলেন আসামি পক্ষের কৌঁসুলিরা।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এই মামলায় মামলার ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩তম সাক্ষী ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা কবির।

এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদিও অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষের তালিকায় ২১১ জন সাক্ষী ছিলেন। এর মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১১৩ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। বাদ বাকি ৯৮ জনের সাক্ষ্য ছাড়াই অভিযোগ প্রমাণ করতে আমরা সক্ষম হব।”

রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুজিবুর রহমান আগামী ৩০ অক্টোবর আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের দিন ঠিক করে দিয়েছেন।

এই আদালতেই চলছে গুলশান হামলার বিচার

ওই দিন আট আসামির সবাইকে বলতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সাক্ষ্য-প্রমাণে তারা দোষী, না নির্দোষ। আত্মপক্ষ সমর্থনে তারা কিছু বলবেন কি না অথবা লিখিত বক্তব্য দেবেন কি না কিংবা তাদেরপক্ষে কেউ সাফাই সাক্ষ্য দেবেন কি না, তাও তাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে।

নিয়ম অনুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের পর হবে যুক্তিতর্ক, তারপর হবে রায়। তবে আসামিরা দোষ স্বীকার করলে বিচারক আগেই সাজার রায় দিতে পারেন।

গুলশান হামলার মামলার আসামিদের কয়েকজন

রোববার আসামি পক্ষের আইনজীবী দেলোয়ার আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানার মামলার অপ্রাপ্ত বয়স্ক এক আসামিকে আবারও জেরা করার (রি-কল) আবেদন করেন। তার আবেদনে সায় দিয়ে আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের দিনে ওই সাক্ষীকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেন বিচারক।

নব্য জেএমবির নেতা নিহত তানভীর কাদেরীর ওই ছেলে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আজিমপুরের ওই মামলায় তার মা আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা ওরফে আশাসহ আসামি। আজিমপুরে অভিযানে তার বাবা তানভীর কাদেরী নিহত হন।

হলি আর্টিজান হামলায় চার আসামির আইনজীবী দেলোয়ার বলেন, “এই মামলায় সাক্ষী হিসেবে ওই কিশোরের ১৬৪ ধারায় একটি জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ৬৯তম ক্রমিকের সাক্ষী হিসেবে সে দিয়েছিল। কিন্তু তাকে জেরা করা হয়নি।”

২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজেন বেকারিতে হামলার পর জঙ্গি দমনে সাঁড়াশি অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনই এক অভিযানে আজিমপুরে প্রাণ হারান গুলশান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী তানভীর, ধরা পড়েন তার স্ত্রী-সন্তান।

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির সাক্ষ্যে বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে।

“হলি আর্টিজান বেকারি কূটনৈতিক এলাকায় অবস্থিত থাকায় সেখানে হামলা করার পেছনে কারণ ছিল জঙ্গিদের নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া। এছাড়া বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটনানোর পাশাপাশি তারা এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রচার করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চেয়েছিল।”

জঙ্গি হামলার পর গুলশানের এই হলি আর্টিজান বেকারিতে অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী

এছাড়া নব্য জেএমবির পরিচয় দিয়ে জঙ্গিরা হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা করে এই দেশে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করে তিনি। 

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “এই হামলার সাথে আমি জড়িত ২১ জনকে শনাক্ত করি। এর মধ্যে ১৩ জন জঙ্গি পুলিশের বিভিন্ন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। বাকি আটজনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।”

তিন বছর আগে ১ জুলাই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে পাঁচ তরুণের সশস্ত্র হামলায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন আরও দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

হামলায় আহত গোয়েন্দা পুলিশের এসি রবিউল ইসলামকে সহকর্মীরা নিয়ে যান হাসপাতালে। ওই রাতেই মৃত্যু হয় তার।

নজিরবিহীন ওই হামলা দেশে জঙ্গিবাদের বিপজ্জনক বিস্তারের মাত্রা স্পষ্ট করে তোলে। বড় ওই ধাক্কা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির গত বছরের ২৩ জুলাই হামলায় জড়িত ২১ জনকে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে জীবিত আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।

চিহ্নিত বাকি ১৩ জন বিভিন্ন অভিযানে নিহত হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। নিহতদের মধ্যে হামলাকারী ৫ তরুণ রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েলও রয়েছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করে ওই হামলা চালিয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে ‘অস্থিতিশীল করা’ এবং বাংলাদেশকে একটি ‘জঙ্গি রাষ্ট্র’ বানানো।

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

আসামিরা হলেন- জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ, সোহেল মাহফুজ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।

এই আসামিদের সবাই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন।