আদালতে অভিযোগপত্র: অবৈধ অস্ত্রে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন’ খালেদ

ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনের মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা পড়েছে, যাতে তার বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ঢাকার বড় একটি এলাকায় ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের’ অভিযোগ করা হয়েছে।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2019, 10:53 AM
Updated : 28 Oct 2019, 11:15 AM

রোববার ঢাকার মূখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. বেলায়েত হোসেন। মহানগর হাকিম দেবদাস অধিকারী অভিযোগপত্রটি ‘দেখিলাম’ বলে স্বাক্ষর করেন।

ঢাকায় গত মাসে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর গ্রেপ্তারদের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে এই প্রথম কোনো মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হল। আইন অনুযায়ী অস্ত্র আইনের মামলায় ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

গত ১৮ সেপ্টম্বর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম, মদ ও জুয়ার ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার করে র‌্যাব। ওই ক্লাব পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি খালেদ ভূঁইয়াকে ওই দিনই গুলশানের বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র ও গুলি, ইয়াবা এবং বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনের পাশাপাশি মুদ্রাপাচার আইনে তিনটি মামলা করা হয় গুলশান থানায়। আর মতিঝিল থানায় মাদক আইনে করা হয় আরেকটি মামলা।এদিকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় রোববারই তাকে সাত দিনের রিমান্ডে পেয়েছে দুদক।

শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে বেড়ে ওঠা খালেদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অবৈধ ‘আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে’ এই যুবলীগ নেতা ও তার বাহিনী রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ. ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর, মুগদা, কমলাপুর, রামপুরা, সবুজবাগসহ আশপাশের এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সাধারণ মানুষ তার ভয়ে আতঙ্কিত ছিল।

১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনের ১৯ (এ) ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, যার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জাফর হোসেন জানিয়েছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, “আসামি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার মতিঝিল এলাকার ইয়ংমেনস ক্লাবসহ বেশ কয়েকটি ক্লাবে জুয়া, ক্যাসিনো, মাদকের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে আসছিল। সে খিলগাঁও-শাহজাহাপুর হয়ে চলাচলকারী গণপরিবহন থেকে নিয়মিত মোটা অংকের চাঁদা আদায়, প্রতি ঈদে শাহজাহানপুর কলোনী মাঠ, মেরাদিয়া এবং কমলাপুর পশুরহাট নিয়ন্ত্রণ, খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ে প্রতি রাতে শক্তির দাপট দেখিয়ে, মাছের হাট বসিয়ে মোটা অংকের টাকা আদায় করা ছিল তার নৈমিত্তিক কাজ।

“এলাকার সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ সব প্রতিষ্ঠানে তার মালিকানাধীন ভূইয়া অ্যান্ড ভূইয়া নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে একচ্ছত্রভাবে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করত এই আসামি।”

১৮ সেপ্টেম্বরে খালেদকে গ্রেপ্তারের পর ইয়াংমেনস ক্লাবে অভিযান পরিচালনার বিষয়টি তুলে ধরে অভিযোগপত্রে বলা হয়, এ সময় ক্যাসিনো সামগ্রী, ক্যাসিনো খেলার নগদ ২৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। এ সময় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় আটক বেশ কয়েকজনকে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এসব অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবৈধ অস্ত্রধারী এক ‘বিশাল বাহিনী’ গড়ে তোলেন খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এবং টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হত ‘অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র’।

তার কাছ থেকে উদ্ধার করা আলামতের মধ্যে একটি শটগান ও একটি পিস্তলের লাইসেন্স নবায়ন করার কথা থাকলেও তা নবায়ন করেননি আসামি, যা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র হিসেবে আইনের দৃষ্টিতে বিবেচিত।

“দুটি অস্ত্রের লাইসেন্সে ৫০ রাউন্ড করে গুলি কেনার হিসেব থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তার হেফাজত থেকে সাত রাউন্ড শটগানের এবং নয় রাউন্ড পিস্তলের অতিরিক্ত গুলি পাওয়া যায়। তাছাড়া উদ্ধারকৃত অন্য আরেকটি পিস্তলের এখনও কোনো  বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট ডিলারের দোকান থেকে সে দুই ধাপে পিস্তল এবং শটগানের ১০ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ ক্রয় করলেও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে রক্ষিত রেজিস্ট্রারে তা নথিভুক্ত করেনি।”

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া মূলত অবৈধ ব্যবসা ও রাজনৈতিক দাপটে পেশি শক্তি প্রয়োগ করার জন্যই দীর্ঘদিন এই অস্ত্রের ব্যবহার করে আসছিলেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

এক সময় ফ্রিডম পার্টি সম্পৃক্ত খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ১৯৯৬ সালে ঢাকা মহানগর যুবলীগে সম্পৃক্ত হন। এরপর ২০১২ সালে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে ওই সব এলাকায় ‘বিশাল সস্ত্রাসী বাহিনী’ গড়ে তোলেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।  

গত ১৯ সেপ্টম্বর গুলশান থানায় খালেদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাটি করেন র‌্যাব-৩ এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. গোলাম মোস্তফা। প্রথমে গুলশান থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. আমিনুল ইসলাম, পরে গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের পরিদর্শক মো. ফজলুল হক এবং শেষে র‌্যাব-৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. বেলায়েত হোসেন এ মামলার তদন্ত করেন।

জি কে শামীমকে তার কার্যালয় থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তার দেহরক্ষীদেরও অস্ত্রসহ আটক করা হয় (ফাইল ছবি)

শামীমের বিরুদ্ধেও অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র

অস্ত্র আইনের মামলায় ঠিকাদার জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।

এতে বলা হয়, শামীম জনমনে ভীতি সৃষ্টি করে বিভিন্ন টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, স্থানীয় বাস টার্মিনাল ও ঈদে গরুর হাটে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন। আর তার দেহরক্ষীরা উচ্চ বেতনভোগী দুষ্কর্মের সহযোগী।

রাজধানীর গুলশান থানায় করা এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১ এর উপ-পরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক রোববার ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন বলে আদালতে সংশ্লিষ্ট সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা শেখ রকিবুর রহমান জানিয়েছেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, জি কে শামীম একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অবৈধ মাদক এবং জুয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। আসামি শামীম অস্ত্রের শর্ত ভঙ্গ করে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদক ব্যবসা ও মুদ্রা পাচার করে আসছিলেন।

তার দেহরক্ষীদের উচ্চ বেতনভোগী ‘দুষ্কর্মের সহযোগী’ উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, “তারা অস্ত্রের লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র বহন ও প্রদর্শন করেছেন। এর মাধ্যমে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করে বিভিন্ন বড় বড় টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসাসহ স্থানীয় বাস টার্মিনাল ও গরুর হাট-বাজারে চাঁদাবাজি করে আসছিলেন।”

জি কে শামীমের দেহরক্ষীরা হলেন- দেলোয়ার হোসেন, মুরাদ হোসেন, জাহিদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, কামাল হোসেন, সামসাদ হোসেন ও আমিনুল ইসলাম।

যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি চালিয়ে আসা শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনে ঠিকাদারি কাজে তার দাপটের খবর সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশ কোটি টাকার এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ পাওয়ার কথা জানায় র‌্যাব। তখন শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পরদিন শামীম ও তার দেহরক্ষীদের গুলশান থানায় হস্তান্তর করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইন এবং মুদ্রা পাচার আইনে তিনটি মামলা করে র‌্যাব। এসব মামলায় তাকে কয়েক দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।