ফেরিতে তিতাসের মৃত্যু: দুই তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছে হাই কোর্ট

একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় অ্যাম্বুলেন্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটির প্রতিবেদন চেয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2019, 07:05 PM
Updated : 23 Oct 2019, 07:05 PM

আগামী ৭ নভেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন রেখে এই সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দুটি দাখিল করতে বলা হয়েছে।

রিটকারী আইনজীবীর সম্পূরক আবেদনের ওপর শুনানির পর বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। আর আবেদনের পক্ষে রিট আবেদনকারী আইনজীবী মো. জহির উদ্দিন লিমন নিজেই শুনানি করেন।

লিমন আদালতে বলেন, “মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দেওয়া প্রতিবেদনে দেরিতে ফেরি ছাড়ার জন্য ঘাট ব্যবস্থাপকসহ ফেরি ঘাটে দায়িত্বরত তিন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি আলোচিত যুগ্ম সচিব আব্দুস সবুর মণ্ডলের দায় খুঁজে পায়নি।

“কিন্তু আদালতের নির্দেশে এ তদন্ত কমিটি গঠনের আগে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্তে যুগ্ম সচিবকে দায়ী করা হয়েছে। কেন, কী কারণে তাকে ওই তদন্তে দায়ী করা হয়েছে, আদৌ তার দায় আছে কি না সে বিষয়গুলো আমাদের, আদালতের জানা দরকার। তাই ওই দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাচ্ছি। ”

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার বলেন, “ফেরি পারাপারে কোন প্রটোকল অনুসরণ করা হয় সেটিও জানা দরকার। যুগ্ম সচিব ভিআইপি কি না, তিনি ভিআইপি সুবিধা পাবেন কি না, জেলা প্রশাসক যুগ্ম সচিবের সফরের বিষয়ে জানেন কি না, জেলা প্রশাসকের দ্বারা এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে কি না- এ বিষয়গুলোও দেখা দরকার।”

এরপরই আদালত নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেয়।

এ সময় তিতাস ঘোষের মা সোনমনি ঘোষ, বোন তানিষা ঘোষ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় যুগ্ম সচিবের ‘দোষ নেই’ বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তিতাসের মা সোনমনি ঘোষ পরে সাংবাদিকদের কাছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন।

তিনি দাবি করেন, ঘাটে দায়িত্বরত কোনো এক কর্মকর্তা তার সামনেই যুগ্ম সচিবকে মোবাইল ফোনে পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিল।

সোনামনি ঘোষ বলেন, “আমার ছেলের পাশে তো আমি ছিলাম। যখন বারবার অনুরোধ করছিলাম ফেরি ছাড়ার জন্য তখন ফেরি ঘাটের একজন আমার পাশে দাঁড়িয়ে সচিবকে ফোন দিয়েছিল। ওই লোক ফোনে বলছিল, স্যার আপনি কি ভাঙা ক্রস করেছেন? তাহলে উনি জানল না কীভাবে? আমি এ কথাটা তো শুনলাম।

“তারপর সাড়ে ১০টার দিকে ফেরি প্লেটটা খুলে দিয়ে আমাদের উপরে উঠাইসে। এর আগে কান্নাকাটি করে বলেছি, ভাই সচিব আগে না জীবন আগে? ১১ বছর আগে স্বামী মারা গেছে, এই ছেলেটাই আমার অবলম্বন। ঘাটের লোকজনের একটা কথা, আমাদের চাকরি থাকবে না। ঘাটের ম্যানেজার অর্ডার দিয়ে গেছে আমাদের- সচিব না এলে ফেরি ছাড়া যাবে না।”

মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়া নড়াইলের কালিয়া পৌর এলাকার একটি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষকে (১১) নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স গত ২৫ জুলাই রাতে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ফেরিতে ওঠে।

কিন্তু সরকারের এটুআই প্রকল্পে দায়িত্বরত আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর রাত ১১টার দিকে ফেরিটি শিমুলিয়া ঘাটের উদ্দেশে রওনা করে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ফেরিতেই মারা যায় তিতাস।

তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএর কর্তাদের অনুরোধ করেও কোনো কাজ হয়নি। এমনকি সরকারি জরুরি সেবার হটলাই ৯৯৯ এ ফোন করা হলেও ফেরি দ্রুত ছাড়তে কেউ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর যুক্ত করে তিতাস ঘোষের পরিবারের জন্য তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে গত ৩০ জুলাই রিট আবেদন করেন মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড পিপলস রাইটসের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জহিরুদ্দিন লিমন।

ওই ঘটনায় মাদারীপুরের জেলা প্রশাসন, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ আলাদা তিনটি তদন্ত কমিটি করে।

এর মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কমিটিতে আবদুস সবুর মণ্ডলের সমপর্যায়ের একজন এবং তার চেয়ে নিচের পদের সাতজনকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া নিয়েও সমালোচনা হয়।

প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে অ্যাম্বুলেন্স, লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি পারাপারের ব্যবস্থা গ্রহণসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদনে যে তিনজনকে দায়ী করা হয়েছে তারা হলেন, ঘাট ম্যানেজার মো. সালাম হোসেন, প্রান্তিক সহকারী মো. খোকন মিয়া এবং উচ্চমান সহকারী ও গ্রুপ প্রধান ফিরোজ আলম।

তাদেরকে কাজে অবহেলা, ঘাট ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও বিআইডব্লিউ পরিপত্র লংঘন করে বিলম্বে ফেরি ছাড়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনটিই বুধবার আদালতে উপস্থাপন করা হয়।