সংঘর্ষের পর রক্ষা পায়নি বোরহানউদ্দিনের হিন্দু পল্লী

ফেইসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে উত্তেজিত মুসলিমদের জড়ো করে যেভাবে হামলা হয়েছিল রামুর বৌদ্ধপল্লীতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের হিন্দু পল্লীতে- ঘটনাচক্র তেমনটি না হলেও সাম্প্রদায়িক এই আঘাত থেকে রক্ষা পায়নি ভোলার বোরহানউদ্দিনের হিন্দু পরিবারগুলো।

মাসুম বিল্লাহ বোরহানউদ্দিন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2019, 11:57 AM
Updated : 23 Oct 2019, 12:07 PM

এক হিন্দু তরুণের ফেইসবুক আইডি হ্যাক করে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট ছড়ানোর পর গত রোববার বোরহানউদ্দিনের ঈদগাঁ মাঠে সমাবেশ ডেকেছিল ‘মুসলিম তাওহিদী জনতা’। ওই সমাবেশ থেকে পুলিশের ওপর হামলার পর তাদের প্রতিরোধে নিহত হয়েছিলেন চারজন।

এই সংঘর্ষ ও প্রাণহানি দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হলেও অনেকটা আড়ালে থেকে যায় ওই সংঘর্ষের পর পাশের হিন্দু পল্লীতে উত্তেজিত মুসলিমদের ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা।

বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ মাঠে সংঘর্ষে পরপর প্রায় এক কিলোমিটার দূরে রবীন্দ্র পল্লীতে (ভাওয়াল বাড়ী) হিন্দুদের একটি মন্দির ও নয়টি বাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়।

সেদিন দলবেঁধে হিন্দু বাড়ি-মন্দিরে হামলা যে ভীতি ছড়িয়েছিল, তা থেকে এখনও বের হতে পারেননি আক্রান্তরা। 

আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব আভা রাণী দাস বলছেন, ঈদগাঁ মাঠে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের খবরে দশ্চিন্তায় পড়েছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি এতটা খারাপ হবে তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তায় আসেনি। কিছু বুঝে উঠার আগেই একদল লোক চলে আসে তাদের পাড়ায়।

কলাপসিপল গেটের বাইরে তালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেন আভা রাণীর পরিবারের ৬-৭ সদস্য। ভেতরে তারা আছে, তা যেন কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য ঘরের সব লাইট-ফ্যান বন্ধ রাখা হয়।

ঘরের পাশের মন্দিরে প্রতীমা আর আসবাব তছনছ করে হিন্দুদের বাড়িমুখো হয় আক্রমণকারীরা। আভা রাণীদের ঘরের জানালা ভেঙে অন্য বাড়ির দিকে চলে যায় তারা।

চার দিন পরে যখন ওই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন আভা রাণী, তখন উত্তেজিত সেসব জনতার আক্রমণের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আতঙ্ক ফুটে ওঠে তার চোখেমুখে।

কী হল, তা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না বলে জানান তিনি।

আভা বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকশ লোক আসে। মন্দিরের ঠাকুর আর সব জিনিস ভাঙতে থাকে। এরপর আমাদের ঘরে এসে জানালার থাই গ্লাস ভেঙে চলে যায়। যাওয়ার সময় বলে, এই ঘরে কেউ নাই চল।”

পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে বেশি শঙ্কায় ছিলেন বলে জানান। “এমন ঘটনা আর কখনও দেখিনি,” বলেন আভা রাণী।

একটি হিন্দু বাড়িতে ভাংচুর চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি আক্রমণকারীরা, ফেরার পথে ওই বাড়িতে আগুনও দেওয়া হয়। আরেকটি বাড়ির সামনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একটি মোটরসাইকেল।

স্থানীয়রা জানান, রবীন্দ্র পল্লীতে প্রায় ৪০টি পরিবারের বাস। ৩৫টি হিন্দু বাড়ির ফাঁকে ফাঁকে বাকিগুলো মুসলিমদের।

হিন্দু বাড়ির মধ্যে চার-পাঁচটি মুসলিম বাড়ি থাকলেও সবার সঙ্গে সম্প্রীতি রয়েছে বলেই জানান আভা রাণী। তিনি বলেন, “হামলাকারীরা এই এলাকার নয়। আমরা কাউকে চিনি নাই।”

মুসলিমদের কারণে পেছনের দিকে কয়েকটি হিন্দু বাড়ি রক্ষা পেয়েছে বলে জানালেন আভা রাণী। তিনি বলেন, “পেছনের দিকে কিছু হিন্দু বাড়ি আছে। যখন ওদিকে ভাঙতে যায়, তখন মুসলমান এক পরিবারই বলছে, এগুলো আমাদের। পরে ওই বাড়িগুলো রক্ষা পায়।”

বুধবার ওই এলাকায় ঘুরে ভাংচুরের পরে যে অবস্থায় ছিল ওই অবস্থায় বাড়ি ও মন্দিরগুলো দেখা যায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে স্থানীয়দের বক্তব্য নিয়েছে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি।

মেয়ের টিউশনি আর নিজের শ্রমে সংসার চলে রবীন্দ্র পল্লীর নারায়ণ চন্দ্র দের। হামলাকারীরা দরজা বন্ধ পেয়ে টিনের বেড়া ভেঙে ভেতরে ঢুকে সব তছনছ করে। সব বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়ে ফেরার পথে এক পাশে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা।

যখন আক্রমণকারীরা আসে তখন পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন নারায়ণের স্ত্রী লক্ষ্মী রাণী দাশ এবং মাস্টার্স পড়ুয়া মেয়ে স্মৃতি দে।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লক্ষ্মী রাণী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৫-৩০ জন ভাগাভাগি হয়ে বাড়িগুলোতে হামলা চালায়। আমাদের ঘরের সামনে তুলসি গাছ আর ঠাকুরের ছবি দেখে আমাদের ঘরে হামলা করে। দরজা বন্ধ থাকায় টিনের বেড়া ভেঙে ভেতরে ঢোকে।

”একে একে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে। পানি যে খাব সেই পাত্রটিও নেই। আমার চাল রাখার একটি ড্রাম ছিল, সেটাও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।”

তার মেয়ে স্মৃতি দে বলেন, “আমাদের ঘর ভেঙে ওরা পেছনের দিকে যায়। পরে সেখান থেকে ফিরে আসে। যাওয়ার সময় দুইজন বলে, এই বাড়ি পোড়ায়া দে। পরে কাপড় চোপড় আর ভেতর থেকে তোষক এনে আগুন ধরিয়ে দেয়।”

স্বল্প আয়ের এই সংসারে আবার কীভাবে ঘর গোছানো আর আসবাবের ব্যবস্থা হবে, তা নিয়ে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না লক্ষ্মী রাণী।

তিনি বলেন, “মেয়ের টিউশনি আর ওর বাবার কিছু আয় দিয়ে সংসারটা চলত। এখন কীভাবে কী হবে, জানি না। ওরা তো আমার সবই শেষ করে দিয়েছে।”

ঘর ধ্বংসের পর এক প্রতিবেশী ও আত্মীয়র বাড়িতে ভাগাভাগি করে আশ্রয় নিয়েছেন নারায়ণ চন্দ্রের পরিবারের চার সদস্য।

হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরের পাশাপাশি পিয়াস চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ীর দোকান ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে। এ ঘটনায় ৪০০-৫০০ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আসামির করে মঙ্গলবার মামলা করেছেন ভাওয়াল বাড়ি শ্রী শ্রী গৌর নিতাই আশ্রমের সভাপতি সত্য প্রসাদ দাস।

ঘটনার দিন নিজেও আক্রান্ত হওয়ার কথা বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান সত্য প্রসাদ।

তিনি বলেন, রোববার দুপুরের দিকে একদল সন্ত্রাসী এসে মন্দিরে হামলা করে প্রতীমা ভাংচুর করে, আসবাব ভাংচুর করে এবং হিন্দু পল্লীর বাড়ি-ঘরে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।

”আমি একজন বুড়ো মানুষ, তবুও তারা আমাকে মারধর করেছে। এমন পরিস্থিতি ছিল, কোনোভাবেই কিছু রক্ষা করতে পারিনি। এখন আমরা চাই যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার হোক এবং আমরা যেন ক্ষতিপূরণ পাই।”

বোরহানউদ্দিন থানার ওসি ম. এনামুল হক বলেন, হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে।

“আমরা প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তারের জন্য কাজ করছি।”