গুলশানে আবাসিক প্লটে উঠছে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভবন

রাজধানীর গুলশানে আবাসিক একটি প্লটে উঠছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন; ওই ভবনে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হবে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2019, 04:26 PM
Updated : 20 Oct 2019, 04:26 PM

গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়কের ওই প্লটের মালিক আঞ্জুমান আরা সাহিদ চৌধুরী। তিনি কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এবং পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাতের স্ত্রী।

এর আগে রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে একটি প্লট কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশকে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম ভাঙা হয়েছিল।

গুলশানে নিয়ম ভেঙে আগে এই ধরনের একটি বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের উদ্যোগ আটকে দেওয়ার পর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির এই ভবন নির্মাণকাজ বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। গুলশান সোসাইটি বলছে, আবাসিক প্লটে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ বন্ধে রাজউককে চিঠি দেবেন তারা।

কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত

রাজউকের নথিপত্রে ১০৩ নম্বর সড়কের ওই প্লটটি আবাসিক এলাকার মধ্যে থাকলেও নাফিজ সারাফাত বলছেন, তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছেন।

রাজউকের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা প্রথমে প্লটটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি না দিলেও পরে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তা দিতে হয়েছে।

এই প্লটটিকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার সময় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।

রাজউকের নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ আঞ্জুমান আরা সাহিদ এ প্লটটি সাইদুর রহমান নামে একজনের কাছ থেকে কেনেন। তিনি ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই প্লটটির বাণিজ্যিকরণ এবং বাণিজ্যিক প্লটের মতো বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার জন্য রাজউকে আবেদন করেন।

তবে এই প্লটটি গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারে ‘বাণিজ্যিক ব্যবহারের আওতাভুক্ত নয়’ উল্লেখ করে আঞ্জুমান আরাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল রাজউক।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আঞ্জুমান আরাকে একটি চিঠিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এই প্লটটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ‘অবকাশ নেই।’

কিন্তু ওই বছরের ৭ নভেম্বর রাজউকের ত্রয়োদশ সাধারণ সভায় প্লটটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আবার উপস্থাপন করা হয়।

ওই সভার কার্যপত্রে দেখা যায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারে বাণিজ্যিক ব্যবহারে আওতাভুক্ত না হওয়ায় গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (ডি) ব্লকের ১০২ ও ১০৩ নম্বর সড়কের বিভাজিত ২২/এ নম্বর প্লটটি ‘বাণিজ্যিকরণ ও বাণিজ্যিক প্লটের ন্যায় বাণিজ্যিক ‘ফার’সহ সকল সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে’ অনুশাসনের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

রাজউকের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে রাজউকের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শ্যামলী নবী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে গুলশান আবাসিক এলাকার ১০২ ও ১০৩ নম্বর সড়কের ২২/এ প্লটকে বাণিজ্যিক প্লটের মতো সুবিধা দিতে বলা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, “যেহেতু গুলশান আবাসিক এলাকার ১০২ ও ১০৩ নম্বর সড়কের সিইএন (ডি) ব্লকের ২২/এ নম্বর প্লটের পাশে পিংক সিটিসহ অন্যান্য কয়েকটি প্লট বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এজন্য এ প্লটটিকেও আবেদন অনুযায়ী, প্রচলিত ফি আদায় সাপেক্ষে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হোক মর্মে মাননীয় মন্ত্রী অনুশাসন প্রদান করেছেন।”

এরপর এক মাস পর ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারি রাজউকের এস্টেট শাখা থেকে প্লটটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এই অনুমতি দেওয়া হল।

ওই প্লটের পাশেই পিংক সিটিসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক ভবন গড়ে উঠেছে বলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হলেও বাস্তবে এই দূরত্ব ৩৮০ মিটার। রাজউক যেসব সড়কে আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক অনুমোদন দিচ্ছে, সেসব সড়কের প্রস্থ কমপক্ষে ৬০ ফিট। কিন্তু গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়ক ৫৪ ফিট প্রশস্ত।

গুলশানের ১০৩ নম্বর সড়কের ওই প্লটে গিয়ে দেখা গেছে, ওই প্লটের চারপাশে বেড়া দিয়ে ভবন তৈরির কাজ চলছে। সড়ক ও ফুটপাত জুড়ে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী।

সেখানে কর্মরত আলীম নামে একজন নিরাপত্তাকর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে মোট ২৪ তলা ভবন হবে। চারতলা বেইজমেন্ট এবং উপরে ২০ তলা ভবন। কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস হবে।”

আবাসিক প্লটে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ  হোক, তা চান না গুলশানের বাসিন্দারা। ১০৩ নম্বর সড়কের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতের আঁধারে নিয়ম ভেঙে ওই প্লটকে বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

“গুলশান একটি সম্ভ্রান্ত নিরিবিলি আবাসিক এলাকা। এজন্যই সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে এই এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছি। কিন্তু এই বাণিজ্যিক ভবনটি হয়ে গেলে এটাকে দেখিয়ে আরও অনেকে বাণিজ্যিক অনুমোদনের জন্য আবেদন করবেন। এটাকে রেফারেন্স দিয়ে আরও ভবন গড়ে উঠবে। আমি মনে করি, বিপুল অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে রাজউক ও গৃহায়ন মন্ত্রণালয় এই কাজটি করেছে।”

২০১৮ সালে এই প্লটের পাশেই সিইএন (ডি) ২১ নম্বর প্লটে একটি বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হলে স্থানীয়দের আপত্তির কারণে তা আটকে যায়।

ওই প্লটে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কার্যক্রম বাতিল করতে গত বছরের ৯ অগাস্ট গুলশানের বাড়ির মালিকদের পক্ষে তিনজন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী বরাবর আবেদন করেন। ৯ সেপ্টেম্বর ওই সড়কের বাসিন্দা এবং খুলনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদীও তার প্যাডে মন্ত্রীর কাছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধে চিঠি দেন। এছাড়া ১৩ সেপ্টেম্বর গুলশান সোসাইটি থেকে ওই ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবি জানানো হয়।

গুলশান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত আবু খায়ের মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চাই আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হোক। এর আগে এই সড়কে একটি প্লটের অনুমোদন বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছি।”

নতুন প্লটটির ক্ষেত্রেও আপত্তি জানিয়ে রাজউককে চিঠি দেবেন বলে জানান তিনি।

নতুন প্লটটির বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য সালাম মুর্শেদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে যখন একটি ভবনকে অনুমোদন দিয়েছিল, তখন আমি ওটা বন্ধ করতে উদ্যোগ নিয়েছি। একটা ভবনের কাজ হচ্ছে সেটা আমি দেখেছি। আমি মনে করি, আবাসিক এলাকায় যখন একটা ২২ তলা বাণিজ্যিক ভবন হবে, তখন আর এটি আবাসিক এলাকা থাকবে না।”

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এই চিঠিতে প্লটটিকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দিতে রাজউককে বলা হয়

এই প্লটটিকে বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়ার সময় রাজউকে চেয়ারম্যান ছিলেন আবদুর রহমান, তিনি বর্তমানে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে রয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাজউক কখনোই আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্লটের অনুমোদন দেওয়ার পক্ষে না।

“আমরা কখনোই চাই না আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা হোক। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে যখন অনুশাসন আসে, তখন কিন্তু এটা অর্ডার হয়ে আসে। তখন অনেক ক্ষেত্রে রাজউকের কিছু করার থাকে না।”

এই প্লটটিকে অনুমোদন দেওয়ার সময় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মোবাইলে ফোন দিলে তিনি ধরেননি। বিষয়টি জানতে চেয়ে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি তিনি।

বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান নাফিজ সারাফাত রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘নিয়মকানুন মেনেই’ সেখানে ভবন তৈরির অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

“আইন-কানুন ছাড়া কিছু হয় নাকি? এটা শতভাগ কমার্শিয়াল সড়ক করে দিয়েছে। এখন যারা ফিস দিবে তারাই কমার্শিয়াল করতে পারবে। এখানে কারও আপত্তি জানানোর কিছু নাই।”

গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার পর ২০১৬ সালে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় ৫৫২টি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক। ওই সময়ে রাজউক অভিযান চালিয়ে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার বেশকিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যেই সেই ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়।

রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, গুলশান এক নম্বর এবং দুই নম্বর সার্কেলের চারপাশের সবগুলো প্লট বাণিজ্যিক। পুলিশ প্লাজা থেকে গুলশান ১ নম্বর হয়ে গুলশান ২ নম্বর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক।

বনানী লেকের পরে গুলশান দুই নম্বর হয়ে বারিধারা-গুলশান লেকের পাড় পর্যন্ত সড়কের দুপাশের প্লটগুলো আবাসিক হলেও তা বাণিজ্যিক করার সুযোগ আছে।

মহাখালী থেকে গুলশান ১ নম্বর যেতে বনানী লেক কালভার্ট পর্যন্ত সড়কের দুপাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক। এরপর কালভার্ট থেকে গুলশান ১ নম্বর সার্কেল হয়ে বাড্ডা যেতে গুলশান লেকের আগ পর্যন্ত প্লটগুলো আবাসিক, তবে রূপান্তর ফি দিয়ে তা বাণিজ্যিক করার সুযোগ আছে।

২০১৭ সালে রাজউক রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার কিছু সড়কের আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া শুরু করে। তবে এসব সড়কের প্রশস্ততা কমপক্ষে ৬০ ফিট হতে হয়।