জাল ফেলছে দুদক, লক্ষ্য শাওন-সামশুলসহ অর্ধশত

অবৈধ পথে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন- সন্দেহভাজন এমন অর্ধশত ব্যক্তিকে নিয়ে অনুসন্ধানে নামছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Oct 2019, 01:17 PM
Updated : 15 Oct 2019, 01:52 PM

এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাবের সঙ্গেও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ক্যাসিনো বন্ধে র‌্যাবের অভিযানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংযোগী সংগঠনের নেতাদের বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার তথ্য প্রকাশের এক মাসের মধ্যে তালিকা ধরে অনুসন্ধানের কথা জানাল দুদক।

জি কে শামীমকে গ্রেপ্তারের সময় তার কার্যালয়ে পাওয়া গিয়েছিল বিপুল অর্থ

দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের তথ্য থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের নাম পেয়েছি। এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের তালিকা তাদের হাতে রয়েছে। এই সংখ্যাটি আরও বাড়বে।”

তিনি জানান, ওই সব ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদ এবং মুদ্রা পাচারের বিষয়টি দেখা হচ্ছে। এতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কমিশন মামলা করবে।

দুদকের হাতে যাদের নাম

দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই তালিকায় চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী এবং ভোলার সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের নাম রয়েছে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চলার মধ্যে যুবলীগের নেতা শাওন ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

অন্যদিকে চট্টগ্রামে র‌্যাবের অভিযান নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, যিনি চট্টগ্রাম আবাহনীর মহাসচিব।

ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের নামও রয়েছে দুদকের তালিকায়।

ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের সঙ্গে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন

সামশুল হক চৌধুরী

জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক জি কে শামীম, তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা ও মা আয়েশা খাতুনের সম্পদের অনুসন্ধানও চালাবে দুদক।

আলোচিত এই ঠিকাদারকে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠায় গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাই ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমানের নাম আছে এই তালিকায়।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. কাওসার, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি এনামুল হক এনু ও তার ভাই থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া, ঢাকা দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা এ কে এম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদ কমিশনার, আরেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুলের সম্পদের খোঁজও নেবে দুদক।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ এবং তাদের সহযোগীদের নামও তালিকায় রয়েছে বলে দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

দুদকের অনুসন্ধান দল

ক্যাসিনো পরিচালনায় জড়িতদের সম্পদের অনুসন্ধানে গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক উদ্যোগ নেয় দুদক।

দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানকে তদারক কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে সেদিন একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। দলের অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সালাউদ্দিন আহম্মেদ, সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজী ও মামুনুর রশিদ চৌধুরী।

দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত

এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার দুদক সচিব দিলোয়ার বখত বলেন, “বিভিন্ন সংস্থা থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের নাম পেয়েছি। যাদের সাথে আমাদের চুক্তি আছে, পত্রপত্রিকা, নিউজ চ্যানেলে আসা সংবাদ সংগ্রহ করে তাদের তথ্য নেওয়া হয়েছে। সেই অনুসারে আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।”

সচিব বলেন, “তাদের (অবৈধ সম্পদের মালিক) তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরপর আমাদের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দেখবেন তারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে কি না, করে থাকলে সেই অর্থ কোথায় ব্যবহার করেছে, তা খুঁজে বের করবেন।”

অনুসন্ধানে তথ্যপ্রমাণ মিললে ওই ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হবে বলে জানান দুদক সচিব।

কমিশনের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে এনবিআর থেকে আয়কর নথিপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে। শিগগিরই সেই তালিকা ধরে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস দেওয়া হবে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনুসন্ধান কর্মকর্তারা তলবও করবেন।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও র‌্যাবের সঙ্গে তথ্য বিনিময়

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান দুদক প্রধান কার্যালয়ে আসেন। এ সময় তিনি ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের অর্থ পাচার ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে হস্তান্তর করেন বলে কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে বলেন, “বিএফআইইউ প্রধান আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের দেখা দেখা করেছেন। তিনি কয়েক ঘণ্টা কমিশনে ছিলেন। তবে কী বিষয়ে তারা কথা বলেছেন তা আমার জানা নেই।”

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, “বিএফআইইউ প্রধান চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে মানলিন্ডারিং সংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দুদক চেয়ারম্যানের কাছে সরবরাহ করেছেন। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানিলন্ডারিংয়ের আর্থিক গোয়েন্দা তথ্যও অবহিত করেছেন তিনি।”

এর আগে বুধবার র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যাদের জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে, তাদের বিষয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হয় বলে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চিহ্নিতদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে দুদক।

“দুদকে বলা আছে, দুর্নীতি দমন কমিশন ব্যবস্থা নিতে পারে, যে কারও ব্যাপারে।”