রিশা হত্যা মামলায় ওবায়দুলের ফাঁসির রায়

ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে তিন বছর আগে ছুরি মেরে হত্যার দায়ে দরজি দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল হকের ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2019, 09:48 AM
Updated : 10 Oct 2019, 03:38 PM

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ বৃহস্পতিবার আসামির উপস্থিতিতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি আসামি ওবায়দুল হককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় মামলার রায়ে।

ওবায়দুলকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারক বলেন, ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, সেজন্যই এই আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া দরকার।

রায় শুনে সন্তোষ প্রকাশ করলেও মেয়ের জন্য আদালতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রিশার মা তানিয়া বেগম। রায় শুনতে উপস্থিত হওয়া উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীরা আদালতের প্রাঙ্গণে আনন্দ প্রকাশ করে।  

অন্যদিকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ওবায়দুল ছিলেন ভাবলেশহীন।

পুরান ঢাকার বংশাল সিদ্দিক বাজারের ব্যবসায়ী রমজান হোসেনের মেয়ে রিশা ঢাকার কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত।

২০১৬ সালের ২৪ অগাস্ট দুপুরে স্কুলের সামনে ফুটব্রিজে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। চার দিন পর হাসপাতালে মারা যায় ১৪ বছর বয়সী ওই কিশোরী।

হামলার দিনই রিশার মা তানিয়া রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় এবং দণ্ডবিধির ৩২৪/৩২৬/৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর আঘাতের অভিযোগে মামলা করেন। রিশা মারা যাওয়ার পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত হয়।

মেয়ে হত্যাকাণ্ডের পর দরজি দোকানের কর্মচারী ওবায়দুলকে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন রিশার মা। রিশার সহপাঠীদের বিক্ষোভের মধ্যে ৩১ অগাস্ট নীলফামারীর ডোমার থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ওবায়দুলকে।

দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মীরাটঙ্গী গ্রামের আবদুস সামাদের ছেলে ওবায়দুল ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং মলে বৈশাখী টেইলার্স নামের একটি দর্জির দোকানের কর্মচারী ছিলেন।

ওই দোকানে কাপড় সেলাই করতে রিশাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মা। তখনই রিশাকে দেখেন ওবায়দুল।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পর ত্রিশোর্ধ্ব ওবায়েদুল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, প্রেমের প্রস্তাবে রিশা রাজি না হওয়ায় তাকে খুন করেন তিনি।

তদন্ত শেষে রমনা থানার পরিদর্শক আলী হোসেন ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর ওবায়দুলকে একমাত্র আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। রিশার চার সহপাঠীসহ ২৬ জনকে সাক্ষী করা হয় সেখানে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, রিশার মা তানিয়া ওই হত্যাকাণ্ডের ৫-৬ মাস আগে রিশাকে নিয়ে বৈশাখী টেইলার্সে কাপড় সেলাই করাতে যান। এরপর দোকানের রসিদের কপি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল ফোনে রিশাকে বিরক্ত করতে থাকেন। রিশা প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ওবায়দুল তাকে ছুরি মেরে হত্যা করেন।

ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল আদালত অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামি ওবায়দুলের বিচার শুরুর আদেশ দেয়।

বাদীপক্ষের ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে মোট ২১ জনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষে বিচারক বৃহস্পতিবার আসামি ওবায়েদুলকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজার রায় দিলেন।

সুরাইয়া আক্তার রিশা

আদালতের বাইরে রিশার স্কুলের শিক্ষার্থীরা

মায়ের কান্না, ভাবলেশহীন ওবায়দুল

বিচারক যখন রায় পড়ছিলেন, তখনই এজলাসে থাকা রিশার মায়ের চোখ টলমল করছিল; মেয়ের খুনির ফাঁসির আদেশ শুনেই কেঁদে ফেলেন তিনি। 

তানিয়া বলেন, “তিনটা বছর আদালতে দৌড়াদৌড়ি করছি। এ রায়ে আমি সন্তুষ্ট। হাই কোর্টে যেন এ আদেশ বহাল থাকে। ওর ফাঁসি যেন দ্রুত কার্যকর হয়।”

“সন্তান হারানো যে কী কষ্টের, যার যায়, সেই বোঝে। এভাবে আর যেন কোনো মায়ের কোল খালি না হয়,” বলেন তিনি।

রিশার বাবা রমজান বলেন, “রায়ে আমরা সবাই সন্তুষ্ট। এ রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়, এই আমাদের চাওয়া।”

রিশার মা-বাবার সঙ্গে ছোট ভাই ও বোনও ছিলেন আদালতে; সহপাঠিদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তার বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষও।

রিশার সহপাঠীরাও রায়ে দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান। তারা বলেন, তাহলে আর কোনো মা-বোনকে হেনস্থা করে কোনো সন্ত্রাসী পার পাবে না।

স্কুলের অধ্যক্ষ আবুল হোসেন বলেন, “আমরা ভালো রায় পেয়েছি। তবে এ রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয়, সেই আশা করছি।”

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু, অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পালও রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।

বাদীপক্ষে আইনি সহায়তাকারী বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ফাহমিদা আক্তার রিংকি রায়ে সন্তোষ জানালেও বিচার প্রক্রিয়া আরও আগে শেষ হওয়া উচিৎ ছিল বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম, মামলাটির বিচার এক বছরের মধ্যেই শেষ হবে। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তারপরও মামলার বিচার শেষ হয়েছে। আসামির মৃত্যুদণ্ডে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি।”

রায় শেষে কারাগারে ফেরত নেওয়া হয় ওবায়দুলকে

কারাগার থেকে বেলা ২টা ৫১ মিনিটে ওবায়দুলকে আদালতে হাজির করা হয়। বেলা ৩টায় বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। ৩টা ২৬ মিনিটে আদালত ওবায়দুলের মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। পরে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

নীল রঙের জিন্স প্যান্ট ও ছাই রঙয়ের  জামা পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ওবায়দুলকে খুব মনোযোগ দিয়ে রায় শুনতে দেখা যায়। শেষ দিকে দণ্ডের অংশ যখন বিচারক পড়ছিলেন, তখন তাকে ভাবলেশহীন, নির্বিকার দেখা যায়।

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা।

‘ভালবাসা যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়’

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক ইমরুল কায়েশ বলেছেন, একজন ব্যবসায়ীর মেয়েকে ভালবাসার অধিকার একজন দরজি দোকানের কর্মচারীর থাকলেও সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়।

“সুরাইয়া আক্তার রিশা একটা স্বনামধন্য স্কুলের ছাত্রী। রিশার মতো একজন ছাত্রীকে একজন টেইলার্সের কাটিং মাস্টার, যে হত্যাকাণ্ড সংগঠন করেছে, তা অসমপ্রেম, কারণ রিশা একজন ব্যবসায়ীর মেয়ে। ভালবাসার অধিকার সবার আছে। তবে সেই ভালবাসা যেন কখনোই সহিংসতায় রূপ না নেয়।”

ওবায়দুলকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেখিয়ে বিচারক বলেন, “রিশার মতো আর কোনো মেয়েকে যেন জীবন দিতে না হয়, এধরনের অপরাধ সংঘটনের সাহস যেন কেউ না করে, সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আসামি পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ সাজা পাওয়ার যোগ্য।”

একটি তরকারি কাটার ছুরি দিয়ে রিশার পেটে আঘাত করেছিলেন ওবায়দুল, যা রায়ে উল্লেখ রয়েছে।

রিশা হত্যার বিচার দাবিতে সরব ছিলেন সহপাঠিরা

মামলায় রিশার মা, বাবা, দুই মামীর পাশাপাশি হাতিরপুল এলাকার বাজারের যে দোকান থেকে ছুরি কিনেছিলেন ওবায়দুল, সেই দোকানের মালিক, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের পাশের ফুট ওভারব্রিজের নিচের চা দোকানিসহ ২২ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

শুনানিতে আসামিপক্ষ বলেছিল, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরিতে আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করা হয়নি।

কিন্তু ছুরির দোকানের মালিকের সাক্ষ্যের কারণে তাদের সেই বক্তব্য টেকেনি আদালতের কাছে।

রিশার মৃত্যুকালীন জবানবন্দি (ডায়িং ডিক্লারেশন) গ্রহণকারী চিকিৎসক, ওবায়দুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণকারী হাকিমও সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন।

আসামিপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ডায়িং ডিক্লারেশনটি কার সামনে করা হয়েছে, সেরকম সাক্ষী দরকার পড়ে। এই ক্ষেত্রে কোনো নিরেপেক্ষ সাক্ষী ছিল না।

কিন্তু সাক্ষ্য আইনের সংশ্লিষ্ট ৩২ ধারা দেখিয়ে বিচারক বলেছেন, এ রকম সাক্ষীদের প্রয়োজন নেই।