আবরারকে নির্যাতনকারীরা ছিলেন ‘মদ্যপ’, তদন্তে পেল ছাত্রলীগ

বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে, ছাত্রলীগের সেই নেতাকর্মীরা তখন ‘মাতাল’ ছিলেন বলে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2019, 02:15 PM
Updated : 8 Oct 2019, 03:58 PM

বুয়েটের শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরারের উপর নির্যাতন কয়েক ঘণ্টা ধরে চললেও তখন হল প্রশাসন ‘নির্লিপ্ত’ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনটি।

হলের শিক্ষার্থীদের ভাষ্য অনুযায়ী, সদ্য স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির সমালোচনা করে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর গত রোববার রাত ৮টার দিকে হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নেওয়া হয় তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (সপ্তদশ ব্যাচ) শিক্ষার্থী আবরারকে। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই তিনি কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি থেকে হলে ফিরেছিলেন।

এরপর রাত ২টার দিকে হলের সিঁড়িতে আবরারের লাশ পাওয়া যায়। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে সোমবারই বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলসহ সংগঠনটির ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

শেরে বাংলা হলে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের আলামত সংগ্রহে পুলিশ (ফাইল ছবি)

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গণমাধ্যমে আসা একটি ফুটেজে দেখা যায়, মধ্যরাতে একটি ছেলেকে হাতের উপর করে বারান্দা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন, তাদের পেছনে পেছনে এগিয়ে আসেন আরও বেশ কয়েকজন।

ছাত্রলীগের তদন্তে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ বলছেন, দোষীদের শনাক্ত করার ক্ষেত্রে তারাও ওই ভিডিও ফুটেজ বিবেচনায় নিয়েছেন। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষার্থী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। 

তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই সোমবার এ ঘটনায় বুয়েটের ১১ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে  ছাত্রলীগ।

ইয়াজ আল রিয়াদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেদিন রাতে (রোববার) যারা এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে তারা পুজায় গিয়েছিলেন। সেখানে তারা মদ পান করেছিলেন। তারা সবাই মারাত্মক রকমের ড্রাঙ্ক ছিলেন। তাদের মধ্যে মানবিকতা বলে কিছুই ছিল না।

“সেখান থেকে এসে তারা একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে আবরারকে তার ১০১১ নম্বর রুম থেকে ২০১১ নম্বর রুমে নিয়ে গিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। যার প্রেক্ষিতে আবরারের মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটে।”

ইয়াজ আল রিয়াদ

তার ভাষ্যমতে, আবরারকে নির্যাতনের ওই কক্ষে তিন থেকে চারজন শিক্ষার্থী থাকেন।

“অন্যান্য রুমের কিছু লোক এই নির্যাতনে অংশ নিয়েছিলেন।”

নির্যাতনের সময় বাইরে থেকে কেউ চিৎকার-আর্তনাদ শোনার খবর জানা গেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যখন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তখন এগুলো বাইরে যায় না। তখন দরজা-জানালা বন্ধ থাকে বলে আমরা জানতে পেরেছি।”

নির্যাতনের এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে আবরার মোবাইলে তার বন্ধু ও সহপাঠীদের সাহায্য চেয়ে সাড়া পাননি বলে এই ছাত্রলীগ নেতার দাবি।

তিনি বলেন, “তদন্তে আরও পেয়েছি, ওই রাতে বার্সালোনার খেলা ছিল। পূজা থেকে এসে আবরারকে শারীরিক নির্যাতনের পর তারা বার্সেলোনার খেলা দেখতে চলে গিয়েছিলেন। আবরার এই ফাঁকে তার এক বন্ধুকে ফোন করে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তার বন্ধু তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেননি। সে আসলে এমন একটি অপমৃত্যুর মতো ঘটনা নাও ঘটতে পারত।”

সোমবার আবরার হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী প্রতিবাদ-সমালোচনার মুখে ইয়াজ আল রিয়াদের সঙ্গে  সংগঠনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদারকে দিয়ে এই তদন্ত কমিটি করে ছাত্রলীগ।

রিয়াদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমিটি করার পর আমরা তৎক্ষণাৎ সেখানে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষার্থী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বে যারা আছেন সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করি।”

২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হলেও তার আগেই কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

‘দায় প্রশাসনের’

হলের মধ্যে অন্য ছাত্রদের হাতে নির্যাতিত হয়ে আবরারের মৃত্যুর জন্য প্রশাসনের ‘দায়িত্বহীনতা ও নির্লিপ্ততাকেও’ দায়ী করেছেন ছাত্রলীগ নেতা রিয়াদ।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হলের মধ্যে রাতভর কয়েক ঘণ্টা ধরে একটা ছাত্রকে নির্যাতন করা হলেও প্রশাসন কেন বিষয়টি জানতে পারল না? হলের প্রভোস্ট, আবাসিক শিক্ষকরা তাহলে কী দায়িত্ব পালন করলেন?

“এই ঘটনায় প্রশাসন দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা কোনোভাবেই এর দায়ভার এড়াতে পারে না।”

তাছাড়া ফেইসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারও মত প্রকাশে ছাত্রলীগ বাধা হতে পারে না বলেও মত দেন তিনি।

রিয়াদ বলেন, “ছাত্রলীগ কখনও কারও ব্যক্তিগত মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না। এমনটি করার অধিকারও নেই। যার যার মত তিনি প্রকাশ করবেন। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কেউ যদি কারও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।

“রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার রয়েছে নিজের মতামত প্রকাশ করার। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেউ যদি কারও মত প্রকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অপকর্ম করে তাহলে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।”