বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
Published : 07 Oct 2019, 12:49 PM
আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সোমবার বুয়েটের শেরে বাংলা হলে অভিযান চালিয়ে এবং সিসিসিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তাদের গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়।
রোববার রাত ২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
ওই হলের শিক্ষার্থীদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরারকে রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে তার ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে যায় কয়েকজন। পরে শিক্ষার্থীরা রাত ২টার দিকে হলের দ্বিতীয়তলার সিঁড়িতে তার লাশ পায়।
লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ জানিয়েছে, আবরারের দুই কাঁধের নিচ থেকে হাতের কব্জি পর্যন্ত কালসিটে ছিল। একইভাবে কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ছিল জখমের দাগ।
সোমবার দুপুরে ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বলেন, “ভোঁতা কিছু দিয়ে মারা হয়েছে। ফরেনসিকের ভাষায় বলে- ব্লান্ট ফোর্সেস ইনজুরি। বাংলা কথায়, ওকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।”
ওই তরুণের হাতে, পায়ে ও পিঠে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে জানিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, “ইন্টার্নাল রক্তক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।”
সহপাঠীদের বরাতে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
নিহত আবরার ফাহাদ
আটক মুহতাসিম ফুয়াদ
সেসব কক্ষ থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। আমরা প্রত্যেকটা অপরাধীকে খুঁজে বের করব।”
একই সুরে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি যতটুকু বুঝি এখানে ভিন্ন মতের জন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার কোনো অধিকার নেই। এখানে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। তদন্ত চলছে, তদন্তে যারা দোষী সাবস্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারসোনালি আমার কোনো ভিন্নমত নেই।”
পুলিশের তদন্তের মধ্যে সকালের দিকে প্রথম দফায় বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদকে আটক করার কথা জানায় পুলিশ। তারা দুজনেই বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র।
পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আরও আটজনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয় বলে সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান কৃষ্ণপদ রায়।
বাকি আটজন হলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মো. মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভির ও একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ইসতিয়াক আহম্মেদ মুন্না।
অবসরপ্রাপ্ত ব্র্যাককর্মী বরকত উল্লাহ-রোকেয়া দম্পতির বড় ছেলে আবরার ২০১৫ সালে কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১৭ সালে ঢাকা নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগে ভর্তি হন।
কুষ্টিয়া শহরের ম আ আব্দুর রহিম সড়কে (পিটিআই রোড) তাদের বাড়িতে সকাল থেকেই চলছে শোকের মাতম। আবরারের হত্যাকারীদের দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি চেয়েছে তার পরিবার।
গত ৫ অক্টোবর ফেইসবুকে দেওয়া সর্বশেষ পোস্টে তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তির সমলোচনা করেন।
এর আগেও ফেইসবুকে তার বিভিন্ন পোস্টের কারণেই তাকে শিবির বলে সন্দেহ করা হয় এবং সে কারণেই তাকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করা হয় বলে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য।
এ ঘটনায় আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ বাদী হয়ে রাতে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে গ্রেপ্তার দশজনসহ মোট ১৯ জনকে আসামি করা হয়।
পুলিশ কর্মকর্তা কৃষ্ণপদ বলেন, “আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে পুলিশ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে। যারা যারা সম্পৃক্ত আছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”
দিনভর বিক্ষোভ
এদিকে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দিনভর বিক্ষোভ চলে বুয়েটে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
শেরেবাংলা হলে রাতেও সহকারী প্রভোস্ট ড.মো. শাহীনুর ইসলাম ও ড.মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আদনানের কক্ষের সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছিল। তাদের একটাই দাবি, ওই কক্ষের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ তাদের দেখতে দিতে হবে।
এক পর্যায়ে প্রভোস্ট ড.মো.জাফর ইকবাল খানের কক্ষে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা। ওই কক্ষের ভেতরে তখন প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট ছাড়াও গোয়েন্দা পুলিশ ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তবে প্রভোস্টের কক্ষ থেকে সহকারী প্রভোস্টদের কক্ষে যাওয়ার আলাদা দরজা থাকায় তাদের আটকা পড়তে হয়নি।
রাত পৌনে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীদের ভিডিও ফুটেজ দিয়ে কক্ষ থেকে বের হয় পুলিশ। তবে বুয়েট কর্তৃপক্ষের কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে আবরারের জানাজা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক-শিক্ষার্থীরা তাতে অংশ নেন।