কাকরাইলের ৯ তলা ভবনজুড়ে সম্রাটের রাজত্ব

ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর কাকরাইলের যে ভবনটি ছিল নগরবাসীর কৌতূহলে, সেই নয় তলা ভূইয়া ট্রেড সেন্টারে যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের অফিস ছাড়া আর কারও কিছু নেই।

কামাল তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2019, 04:24 PM
Updated : 6 Oct 2019, 06:33 PM

এখনও নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়া ওই ভবনের চতুর্থ তলায় যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সম্রাটের অফিস, পাশেই খাবারের ক্যান্টিন। পাঁচ তলায় পাওয়া যায় আদা, আলু ও রান্নার সরঞ্জাম।

ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছোট ছোট অফিস আর সম্রাট এবং সংগঠনের নেতাকর্মীদের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। তবে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলার দক্ষিণের অংশ নির্মাণাধীন, ওই ফ্ল্যাটগুলোতে কোনো কাজ করা হয়নি। বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর আবর্জনা পড়েছিল সেখানে।

সম্রাটের অফিসে পাঁচ ঘণ্টার অভিযান শেষে বন্যপ্রাণী আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ষষ্ঠ তলার একটি কক্ষে একটি বিশেষ ধরনের চেয়ার দেখতে পাওয়া যায়। সেটি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপস্থিত একজন র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, এই চেয়ার সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই।

ভবনের ছাদের দক্ষিণ দিকে তৈরি করা হয়েছে একটি মনোরম বাগান; সেখানে রয়েছে কলাগাছসহ বিভিন্ন ছোট ছোট গাছ। দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি কৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণাও রাখা হয়েছে।

ভবনের ছাদে মনোরম বাগান তৈরি করেছিলেন সম্রাট

উত্তর পাশে একটি কক্ষ দেখতে পাওয়া যায়। ওই কক্ষে একটি বেড, এটাচড বাথরুম রয়েছে। তার পাশে আরেকটি কক্ষে একটি টেবিলে রয়েছে। বাগানের পূর্বপাশে রয়েছে একটি বড় হল রুম।

ছাদে ওঠার সিঁড়িও ভিন্ন, ভবনের পশ্চিম কোণে একটি সরু সিঁড়ি দিয়ে এখানে উঠতে হয়। ছাদের এই পুরো আয়োজনকে ‘সম্রাটের বাংলো’ বলেন সেখানে অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব সদস্যরা।

অফিসে বিশ্রাম নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সম্রাট

ছাদসহ পুরো নয়তলা ভবনই ছিল সম্রাটের দখলে। সেখানে অন্য কারও বসবাস বা কারও অফিস ছিল না।

এই ভবনটি কার জানতে চাইলে রমনা থানার ওসি মাইনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আশরাফ ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তি এর মালিক।”

তবে আশরাফ সম্পর্কে আর কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি। অন্যান্য ফ্লোর ভাড়া দেওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আশরাফ ভূঁইয়া কখনও থানায় কোনো অভিযোগ করেননি।”

পুরো ভবনটি সম্রাট তার কাছ থেকে ‘ভাড়া’ নিয়ে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

ভবনের ছয়তলায় পাওয়া গেছে এই চেয়ার, তবে এর সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেননি র‌্যাব কর্মকর্তারা

তবে ওই অফিসের বিষয়ে সম্রাটের স্ত্রী শারমিন চৌধুরী বলেছেন, “যে ফ্লোরে সম্রাটের অফিস সেটিই শুধু তার। ওই ভবনে ঢুকতে যে কড়া চেকের মধ্যে পড়তে হয়, সে কারণে সেখানে আর কেউ ওঠেনি।”

ওই অফিসের বিষয়ে একজন যুবলীগ কর্মী নাম প্রকাশের না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চারতলায় ওই অফিসে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, পাশের ক্যান্টিনে বসে খেয়েছি। কিন্তু ছাদে বাংলো আছে তা জানা ছিল না।”

 

স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, দিনের একটি বড় সময় এই অফিসে কাটাতেন সম্রাট। তার অনুসারী যুবলীগ নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও ছিল অন্যদের চোখে পড়ার মতো।

গত ১৮ সেপ্টেম্বরে ফকিরাপুল, গুলিস্তান এলাকায় কয়েকটি ক্লাবে র‍্যাবের অভিযানে ক্যাসিনো চালানোর বিষয়টি ধরা পড়ার পর সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদা মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে পাওয়া পদকগুলো গুছিয়ে রেখেছিলেন সম্রাট

সম্রাটকেও গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে গুঞ্জন ছড়ালে কয়েকশ নেতাকর্মী নিয়ে কাকরাইলের এই কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন ঢাকায় যুবলীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত সম্রাট। রাতভর তার নামে স্লোগান দিতে থাকেন ওই নেতাকর্মীরা। এভাবে তিনি সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন; পরে আত্মগোপন করেন।

রোববার ভোর রাতে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তারের পর দুপুরে যখন সম্রাট নিয়ে র‌্যাব ওই কার্যালয়ে অভিযানে যায়, তখনও আশপাশে অবস্থান নিয়েছিলেন যুবলীগ নেতাকর্মীরা।

তাদের কখনও পামের রয়েল কিং ফটোকপির দোকানের সামনে সিঁড়িতে বসে থাকতে, কখনও ‘বিপাশা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের’ সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সে সময় পরিচয় জানতে চাইলে তারা এড়িয়ে যান।

তবে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার অভিযানে শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে যখন সম্রাট নিয়ে বের হন র‌্যাব সদস্যরা তখনই তার নামে স্লোগান দিতে শুরু করেন ওই যুবলীগ কর্মীরা।

কাকরাইলের এই অফিসের সামনে সম্রাটের পক্ষে স্লোগান দেওয়ায় যুবলীগের তিন কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ

‘সম্রাট ভাই ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী।

হঠাৎ করে স্লোগানে ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা তখন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সরিয়ে দিতে তৎপর হয় পুলিশ। ধাওয়ায় পাশের রমনা থানার সামনের সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে সরে যান তারা।

এ সময় যুবলীগের তিন কর্মীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

তাদের পরিচয় জানতে চাইলে ওসি মাইনুল বলেন, “এরা নামধারী যুবলীগ, কিন্তু কোনো পদে নেই।”

সম্রাটের অফিস থেকে উদ্ধার করা হয় বিদেশি মদ ও ইয়াবা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সম্রাটের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, ১১৬০টি ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া পেয়েছে র‌্যাব।

এছাড়া সেখানে দুটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও দুটি লাঠি পাওয়া গেছে, সেগুলো নির্যাতন করার কাজে ব্যবহার করা হত বলে ধারণা র‌্যাব কর্মকর্তাদের।

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, অভিযানের সময় সম্রাটের বিরুদ্ধে ‘তিন ধরনের অপরাধের আলামত’ পেয়েছেন তারা। এর একটি বন্যপ্রাণী আইনে, বাকি দুটি মাদক ও অস্ত্র আইনে।

দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়াও উদ্ধার করা হয়েছে সেখান থেকে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে সম্রাটকে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে তাৎক্ষণিকভাবে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া মাদক ও অস্ত্র পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে আরও দুটো মামলা করা হবে বলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান।

তিনি বলেন, কুমিল্লায় অভিযানের সময় যুবলীগ নেতা আরমানকে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠায়।