সফরের তৃতীয় দিন শনিবার নয়া দিল্লিতে শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এটি ছাড়াও ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
এছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন তিনটি যৌথ প্রকল্প। এর মধ্যে দুটি বাংলাদেশের খুলনা ও ঢাকায় ভারতের অর্থায়নে নির্মিত; আরেকটি বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি নেওয়ার প্রকল্প।
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার সঙ্গে দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও একমত হয়েছেন। চেন্নাইয়ে বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশন প্রতিষ্ঠায়ও সায় মিলেছে।
তবে বৈঠক শেষে দুই প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে বহুল আলোচিত আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রসঙ্গও উল্লেখ করা হয়নি, যা নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ রয়েছে।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, ‘সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে’ এই চুক্তি নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতে ভারতের সব অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে তার সরকার।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে চুক্তি আটকে যাওয়ার পর থেকেই এই কথা বলে আসছে নয়া দিল্লি। অপরদিকে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের যে কোনো বৈঠকেই এই চুক্তি নিয়ে অগ্রগতির আশা থাকে বাংলাদেশে।
শনিবারের এই বৈঠকে বিষয়টির সুরাহা না হলেও ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারত যেন ত্রিপুরার একটি শহরে সরিয়ে নিতে পারে, সেজন্য একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
এ বিষয়ে পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী মানবিক কারণে এটি দিয়েছেন।”
তিনি জানান, দুই প্রধানমন্ত্রী এখন অভিন্ন অপর ছয়টি নদীর পানি বণ্টনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন।
সচিব জানান, ভারত-বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের এই বৈঠকে পানি বণ্টন ছাড়াও রোহিঙ্গা সংকট, এনআরসি, ব্লু ইকোনোমি, যোগাযোগ, ব্যবসা ও বাণিজ্য, শিক্ষা, যুব উন্নয়ন ও সংস্কৃতি বিনিময় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকে উভয় নেতা দুই দেশের ‘অসাধারণ’ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে ‘সন্তোষ’ প্রকাশ করেছেন। ঐতিহাসিক ও ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দুই দেশের সার্বভৌমত্ব, সমতা, আস্থা ও বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে সব ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে, যা ‘স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপকে’ ছাড়িয়ে গেছে।
দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সব দিক পর্যালোচনা করেছেন এবং আঞ্চলিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করেছেন। যে কোনো ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক অংশীদারিত্ব এগিয়ে নেওয়ার সুযোগকে পুরোদমে কাজে লাগানোর বিষয়ে একমত হয়েছেন তারা।
>> উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোয়েস্টাল সারভাইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ।
>> চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) সই হয়েছে।
>> স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত; ওই পানি তারা ত্রিপুরা সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে।
>> চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে।
>> সহযোগিতা বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব হায়দরাবাদের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
>> এছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিনিময় নবায়ন এবং যুব উন্নয়নে সহযোগিতা নিয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে এনআরসির প্রসঙ্গ উল্লেখ না থাকলেও বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “এনআরসি ইস্যুতে বলেছি, আমরা মনে করি এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা আশা করি, বন্ধু দেশ হিসেবে ভারত তার কমিটমেন্ট রাখবে।”
গত মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফরে এসে বলেছিলেন, এটা তাদের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং কোনোভাবে বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না।
তবে তারপরে আসামের অর্থমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে ১৪-১৫ লাখ ‘অবৈধ অভিবাসীকে’ বাংলাদেশে ফেরত নিতে বলার পরিকল্পনার কথা জানালে বিষয়টি নিয়ে নানা মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়। এরপরে অবশ্য নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছিলেন বলে তার মুখপাত্র জানান।
গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এবং আসামে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পর এটাই তার প্রথম নয়া দিল্লি সফর।
রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়াই সব থেকে উত্তম বলে দুই প্রধানমন্ত্রীই একমত হয়েছেন বলে জানান সচিব শহীদুল হক।
“সেইটা করার জন্য যেটা করা প্রয়োজন সেজন্য মিয়ানমারকে আমরা সবাই মিলে কনভিনস করি- এই বিষয়েও দুইজন একমত হয়েছেন,” বলেন তিনি।
“উভয় নেতা বাস্তুচ্যুত এই ব্যক্তিদের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজ ভূমিতে নিরাপদে, দ্রুত ও স্থায়ী প্রত্যাবাসন ত্বরাণ্বিতের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে একমত হয়েছেন। এজন্য মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ বৃহত্তর প্রয়াস নেওয়ার প্রযোজনীয়তার বিষয়েও তারা একমত হয়েছেন।”
মোদী জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য ভারতের মানবিক ত্রাণ সহায়তার পঞ্চম চালান পাঠানো হবে।
এই চালানে তাঁবু ও উদ্ধার কার্যক্রমের সরঞ্জামের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে এক হাজার সেলাই মেশিন পাঠানো হবে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রথম প্রকল্পে আড়াই হাজার বাড়ি নির্মাণ কাজ শেষ করেছে ভারত। এখন তারা ওই এলাকায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের আরেক গুচ্ছ প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতীয় সহায়তার জন্য ঢাকার কৃতজ্ঞতা জানান শেখ হাসিনা।
চেন্নাইয়ে ডেপুটি হাই কমিশন নিয়ে আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “অনেক দিন ধরে আমরা অনুরোধ করছিলাম চেন্নাইতে একটা ডেপুটি হাই কমিশন খোলার ব্যাপারে। ভারত এই ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। খুব শীঘ্রই সেটা খোলা হবে।”
বৈঠকে শেখ হাসিনা নরেন্দ্র মোদীকে আগামী বছর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সফরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন বলেও জানান তিনি।