‘ত্রিনয়নীর’ ঘুম ভাঙিয়ে উৎসবের শুরু

নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে মহাষষ্ঠী তিথিতে কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মধ্য দিয়ে বাঙালির শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2019, 07:24 AM
Updated : 4 Oct 2019, 07:24 AM

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের দুর্গোৎসবের শেষ হবে। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেলতলায় ত্রিনয়নী দেবীর নিদ্রাভঙ্গের আবাহন- অর্থাৎ বোধনের মাধ্যমে এবারের দুর্গোৎসবের আচার পর্ব শুরু হয়। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় শুরু হওয়া বন্দনা পূজার সমাপন হয় বিহিত পূজায়। আবাহনের মাধ্যমে মূল মণ্ডপে দেবী আসীন হওয়ার পর সন্ধ্যায় দেবীর অধিবাস।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “ষোড়শ উপচারে দেবী দূর্গাকে মর্ত্যে আবাহন করেছি আমরা। সকাল সাড়ে ৮টায় ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজার মাধ্যমে শুরু হয়েছে মূল আচার। ৯টা ৫৮ মিনিটে সেই পূজা শেষ হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বিল্ববৃক্ষ (বেলগাছ) মহাদেবের ভীষণ প্রিয়, পদ্মযোনী ব্রহ্মাও বিল্ববৃক্ষে দেবীকে প্রথম দর্শন করেন। তাই আমরা দেবীকে বিল্ববৃক্ষ তলেই আবাহন করছি। বিল্ববৃক্ষ তলে দেবী আবাহনের মধ্যে সংকল্প করেছি, দশমী পর্বন্ত যথাবিধ উপায়ে আমরা মায়ের পূজা করব।”

দেবীপক্ষের সূচনা হয় আশ্বিন শুক্লপক্ষের অমাবস্যার দিন; সেদিন মহালয়া। আর দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিনে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপূজার মধ্যে দিয়ে। এর মাঝে ষষ্ঠ দিন, অর্থাৎ ষষ্ঠীতে বোধন। আর দশম দিন, অর্থাৎ দশমীতে বিসর্জন। দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা এই পাঁচদিনই চলে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, তিন অবতারের আবির্ভাবকাল ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।

রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গাপূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।

পুরোহিতরা বলছেন, দুর্গা দেবীর প্রকৃত আগমনের সময় চৈত্র মাস। অর্থাৎ বসন্ত কাল। চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা হয় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা। তবে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে শারদীয় পূজাই সবচেয়ে বড় উৎসব।

শাস্ত্র বলছে, এবার সপ্তমী, অর্থাৎ দেবীর আগমনের দিন শনিবার এবং ফেরার দিন মঙ্গল হওয়ায় দুর্গা এবার আসছেন ঘোটকে বা ঘোড়ায় চেপে, একই বাহনে তিনি ফিরবেন।

দুর্গার ঘোড়ায় চড়ে এলে বা গেলে তার ফল হয়- ‘ছত্রভঙ্গস্তুরঙ্গমে’। অর্থাৎ- সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংসারিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, দুর্ঘটনা, অপমৃত্যুর শঙ্কা। 

পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, “মায়ের ঘোড়ায় চেপে আসা অমঙ্গলের লক্ষণ। কিন্তু আমরা প্রার্থনা করব, করুণাময়ী মা যেন সব অকল্যাণ থেকে আমাদের গোটা পৃথিবীকে রক্ষা করেন। আমরা পূজায় প্রার্থনা করব, পৃথিবীর সকল প্রাণ প্রকৃতির জন্য।”

ঢাকা মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিশোর রঞ্জন মণ্ডল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুর্গোৎসব যেন সবাই নির্বিঘ্নে উদযাপন করতে পারেন, তার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নিয়েছেন। আজ থেকে দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হল। তবে আমরা তো শুধু মায়ের আরাধনাই করি না, একইঙ্গে ভাতৃত্ব আর প্রীতির বার্তাও ছড়াতে চাই এই পূজা উৎসবের মাধ্যমে। সমৃদ্ধি কামনা করি দেশ ও জাতির।”

দশভূজা দুর্গার শক্তি রূপের আরাধনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এবার ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসার বিনাশ চেয়ে ‘বিশেষ প্রার্থনা’ করবে বলেও জানান তিনি।

শুক্রবার বিকালে রাজধানীর ‘বিশেষ শ্রেণিভুক্ত’ তিন মন্দির রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠ, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা মণ্ডপে যাবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

সোমবার বিকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে পূজার শুভেচ্ছা বিনিময় করতে যাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শনিবার সকাল ১০টায় নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনের পর শুরু হবে মহাসপ্তমীর পূজা। রোববার মহাঅষ্টমী পূজা, সেদিন হবে সন্ধিপূজা। রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠে হবে কুমারী পূজা।

সোমবার সকালে বিহিত পূজার মাধ্যমে হবে মহানবমী পূজা। আর মঙ্গল সকালে দর্পণ বিসর্জনের পর প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

সেদিন বিকাল ৩টায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বের হবে মূল শোভাযাত্রা। পরে নগরীর ওয়াইজঘাট, তুরাগ, ডেমরা, পোস্তগোলা ঘাটে হবে প্রতিমা বিসর্জন।

সারা দেশে মঙ্গলবার রাত ১০টার মধ্যে নিরঞ্জন (প্রতিমা বিসর্জন) শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে পূজা উদযাপন পরিষদ।

উৎসব উপলক্ষে মন্দিরে আরতি ও সংগীত প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বিশেষ প্রসাদ বিতরণ করা হবে উল্লেখযোগ্য মণ্ডপগুলোতে।

এ বছর সারা দেশে ৩১ হাজার ৩৯৮টি মণ্ডপে দুর্গা পূজার আয়োজন হয়েছে, যা গতবারের চেয়ে ৪৮৩টি বেশি। রাজধানীতে ২৩৬টিসহ ঢাকা বিভাগে ৭ হাজার ২৭১টি মণ্ডপে এবার পূজা হবে।

এছাড়া চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৪৫৬টি, সিলেটে ২ হাজার ৫৪৫টি, খুলনায় ৪ হাজার ৯৩৬টি, রাজশাহীতে ৩ হাজার ৫১২টি, রংপুরে ৫ হাজার ৩০৫টি, বরিশালে ১ হাজার ৭৪১টি, ময়মনসিংহে ১ হাজার ৬৩২টি মণ্ডপে দুর্গা পূজা এবার অনুষ্ঠিত হবে।