যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে হাজার কোটি টাকার সরকারি কাজের ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে বুধবার ঢাকার হাকিম আদালতে দেখা গেল এরকম বিচিত্র মেজাজে।
অস্ত্র ও মাদক আইনের দুই মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড শেষে জি কে শামীমকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাকে অস্ত্র মামলায় আরও সাতদিন এবং মানি লন্ডারিং মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাওয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
বেলা ৩টায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলায় মহানগর হাকিম মো. তোফাজ্জল হোসেন মুদ্রা পাচার মামলায় জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন।
এ সময় কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জি কে শামীমের আইনজীবী হিসেবে বেশ কয়েকজন আাইনজীবী ওকালতনামা এগিয়ে দিলে শামীম দ্বিধায় পড়ে যান। আইনজীবীদের কাড়াকাড়ি, হুড়োহুড়িতে এ সময় তাকে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যায়।
কার ওকালতনামায় সই করবেন তা নিয়ে এজলাসে উপস্থিত নিজের কয়েকজন লোককে বার বার প্রশ্ন করতে থাকেন জিকেবি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডি শামীম। তাড়াহুড়ার মধ্যে বিরক্ত শামীমকে বলতে শোনা যায়, সব আইনজীবীর ওকালতনামায় তিনি স্বাক্ষর করবেন না।
পরে বিচারক তাকে মুদ্রাপাচার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করলে আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এস আই শেখ রকিবুর রহমান তাকে সেই আদেশ পড়ে শোনান।
পরে রিমান্ড শুনানির জন্য শামীমকে তোলা হয় একই ভবনের ষষ্ঠ তলায়, মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিমের এজলাসে।
এসময় একজন আইনজীবীকে দেখিয়ে শামীম বলেন, “ইনি আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার। তিনি সিলেক্ট করবেন কে কে শুনানি করবেন।”
শুনানিতে কারা থাকবেন সে বিষয়ে ওই আইনজীবীকে সমন্বয় করতে বলেন শামীম।
ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানের মধ্যে গত ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা, পৌনে দুইশ কোটি টাকার এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ পাওয়ার কথা জানায় র্যাব। শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে ওই সময়ই গ্রেপ্তার করা হয়।
পরদিন শামীম ও তার দেহরক্ষীদের গুলশান থানায় হস্তান্তর করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইন এবং মানিলন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করে র্যাব। আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে অস্ত্র ও মাদক মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।
‘মোল্লা কাওসার কই?’
অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য শামীমকে কাঠগড়ায় তোলার পর বিচারক এজলাসে আসার আগে নিজের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় তাকে।
সহযোগীরা এ সময় জানতে চান, রিমান্ডে তার সঙ্গে কোনো দুর্ব্যবহার করা হয়েছে কি না। উত্তরে শামীম বলেন, “তারা আমাকে সম্মান করে কথা বলেছে। কোনো অত্যাচার করেনি।”
এর পর শামীমের স্ত্রী কথা বলতে চাইলে পুলিশ তাকে সুযোগ দেয়। শামীম হাসিমুখে স্ত্রীর সঙ্গে মামলার বিষয়ে কথা বলেন, দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেন। বলেন, রিমান্ডে তার কোনো কষ্ট হয়নি, ‘বেশ ভালো আচরণ’ করা হয়েছে।
এক পর্যায়ে আইনজীবীদের কাছে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “মোল্লা কাওসার কোথায়? তিনি আসেন নাই?”
এ সময় একজন উত্তর দেন, “উনিতো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কি করে আসবেন! ”
মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো চালানোর সঙ্গে যাদের নাম এসেছে, তাদের একজন হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে তিনি দেশের বাইরে চেলে গেছেন বলে খবর এসেছে সংবাদ মাধ্যমে।
শুনানিতে যা হল
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত হোসেন হিরণ অস্ত্র আইনের মামলায় শামীমকে আরও সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে শুনানি করেন। অন্যদিকে তার বিরোধিতা করেন শামীমের আইনজীবী আব্দুর রহমান হাওলাদার।
তিনি বলেন, “প্রসিকিউশনের সব বক্তব্য মিথ্যা। তার (শামীমের) সব অস্ত্র লাইসেন্স করা। তার কাছ থেকে যে ৩২ বোরের পিস্তল পাওয়া গেছে বলে মামলায় বলা হয়েছে, তা সঠিক নিয়মে নিবন্ধিত ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। অস্ত্রের লাইসেন্সের দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট তো সেই লাইসেন্স বাতিল করেননি। আগে লাইসেন্স বাতিল করেন, তারপর বলেন যে অবৈধ অস্ত্র রাখছি।”
এ মামলায় একবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আবারও কেন রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখেন শামীমের আইনজীবী।
এ পর্যায়ে বিচারক মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম দুই মামলার রিমান্ড শুনানির আদেশ একসঙ্গে দেবেন জানিয়ে মুদ্রা পাচার মামলার রিমান্ড শুনানি শুরু করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্যের পর আব্দুর রহমান হাওলাদার বলেন, “আমার মক্কেল এখন ১৯টি বড় কাজ করছেন ঠিকাদার হিসেবে। র্যাবের হেডকোয়র্টার ৪৩৮ কোটি টাকার কাজ, সংসদ ভবনের কাজ, রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ, সচিবালয়ের তিনিটি ভবনের কাজ, পঙ্গু হাসপাতালের কাজ, এনবিআর ভবনের (জাতীয় রাসজস্ব বোর্ড ভবন) কাজ, নিউরো মেডিসিন ভবনের কাজ করছেন তিনি।”
কোন কাজ কত টাকার, সেই তথ্য শুনানিতে তুলে ধরে আইনজীবী বলেন, “তিনি একজন আয়করদাতা, ভ্যাটদাতা, সফল ও বড় ব্যবসায়ী। সরকার ও রাষ্ট্রের কল্যাণে বড় অংশীদার। টাকা থাকা কি অপরাধ? তার কার্যালয়ে অনেক টাকা থাকবে, এটাতো অত্যন্ত স্বভাবিক ঘটনা। তার কয়েকশ কর্মী রয়েছে। তার কোটি টাকার ডিলিংস, ট্র্যানজেকশন। তিনি তো পাচারের জন্য এসব টাকা রাখেননি।”
হঠাৎ অসুস্থ
শুনানির একপর্যায়ে কাঠগাড়য় দাঁড়ানো শামীমকে বুকে হাত দিয়ে লোহার শিকে মাথা রেখে শুনানি শুনতে দেখা যায়। এ সময় তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল।
কিছুক্ষণ পর মৃদু স্বরে তিনি বলতে থাকেন, “আমার বুকে ব্যথা, ওষুধ কই?”
এজলাসে উপস্থিত কয়েকজন আইনজীবী তখন পুলিশ ও শামীমের স্ত্রীকে ওষুধের কথা বলেন। এক পর্যায়ে শামীম কাঠগড়ায় বসে পড়েন।
কোর্ট হাজতের ওসি শামীমকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে বিচারক জানতে চান- আসামির কী হয়েছে। কী সমস্যার জন্য তাকে কী ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে, তা পুলিশকে দেখতে বলেন তিনি।
২০ মিনিট শুনানি শেষে আদেশ দেন বিচারক। জামিনের আবেদন নাকচ করে অস্ত্র আইনের মামলায় ৪ দিন এবং মুদ্রা পাচারের মামলায় ৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেওয়া হয় পুলিশকে।
চিকিৎসার জন্য শামীমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়ার আবেদন করেছিলেন তার আইনজীবী। আদেশে বিচারক বলেন, এ বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে কারা কর্তৃপক্ষ।
আব্দুর রহমান হাওলাদারের সঙ্গে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রচিও এদিন শামীমের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন।