টাকা চাইতে নয়, ফোন দিয়েছিলাম খোঁজ নিতে: রাবি প্রোভিসি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক পদে চাকরি না পাওয়া স্বর্ণপদকধারী এক ছাত্রের স্ত্রীর সঙ্গে উপ-উপাচার্যের ফোনালাপ প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনা চলছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিশফিকুল ইসলাম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Oct 2019, 03:25 PM
Updated : 1 Oct 2019, 03:31 PM

আলোচনা-সমালোচনার মুখে উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়া মঙ্গলবার বিকালে এক বিবৃতিতে মোহাম্মদ নুরুল হুদা নামে ওই ছাত্রের স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার কথা স্বীকার করলেও নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন।

তিনি বলেছেন, “ওই অডিও এডিট করে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।”

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলার মধ্যে গত নভেম্বরে ফোনালাপটি হলেও তা ফেইসবুকে প্রকাশ হয়েছে সোমবার, যেদিন ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন গোপালগঞ্জের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন জোরদার হয়েছিল এক ছাত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হলে। সেখানে ওই ছাত্রীকে হুমকি-ধমকির পাশাপাশি তার বাবাকে নিয়েও কটাক্ষ করতে শোনা যায় অধ্যাপক নাসিরকে।

২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তিনজন প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে প্রার্থী ছিলেন এই বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র নুরুল হুদা, যিনি স্নাতকে ৩.৬৫ ও স্নাতকোত্তরে ৩.৬০ সিজিপিএ পেয়ে প্রথম হয়েছিলেন। আইন অনুষদে সেরা ফল করায় ২০১৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক এবং ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন নুরুল হুদা। তার বাড়ি উপ-উপাচার্য জাকারিয়ার জেলা লালমনিরহাটে।

২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা হয়। পরে ১৭ নভেম্বর সিন্ডিকেট সভায় নির্বাচিতদের নিয়োগ অনুমোদিত হয় এবং পরদিন ১৮ নভেম্বর নিয়োগপ্রাপ্তরা বিভাগে যোগ দেন।

নুরুল হুদা তাদের মধ্যে ছিলেন না। চাকরি পেয়েছিলেন উপ-উপাচার্য চৌধুরী মো. জাকারিয়ার মেয়ের জামাই সাইমুন তুহিন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডুর মেয়ে নূর নূসরাত সুলতানা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী বনশ্রী রানী।

ওই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই নুরুল হুদার স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তুজ সাদিয়ার সঙ্গে উপ-উপাচার্যের ওই ফোনালাপ হয়েছিল বলে বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে।

অডিওতে আসা কথোপকথন হুবুহু তুলে ধরা হল-

উপ-উপাচার্য: হ্যাঁ, তুজ সাদিয়া। আমি প্রফেসর জাকারিয়া (চৌধুরী মো. জাকারিয়ার), প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।

নুরুল হুদার স্ত্রী: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।

উপ-উপাচার্য: ওয়ালাইকুমুস সালাম। আচ্ছা মা, একটা কথা বলতো, আমার খুব শুনতে

ইচ্ছা, তোমরা কয় টাকা দেওয়ার জন্য রেডি?

নুরুল হুদার স্ত্রী: স্যার, সত্যি কথা বলতে...

উপ-উপাচার্য : না না, সত্যি কথাই তো বলবা। উপরে আল্লাহ তায়ালা, নিচে আমি।

চাকরিপ্রত্যাশীর স্ত্রী: অবশ্যই, অবশ্যই। স্যার, আপনি যেহেতু তার অবস্থা জানেন, আরেকটা বিষয় এখানে স্যার, সেটা হচ্ছে, আপনি হুদার... মানে, এমনিতে সে কতটা স্ট্রিক প্রিন্সিপালের..., আপনি বোধহয় এটাও জানেন স্যার, একটু রগচটা ছেলে।

উপ-উপাচার্য: আচ্ছা রাখো রাখো, এখান থেকে কথা বলা যাবে না।

নুরুল হুদার স্ত্রী তুজ সাদিয়ার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল বলেও স্বীকার করলেও নিজে টাকা চেয়ে ওই ফোন করেননি বলে দাবি করেছে অধ্যাপক জাকারিয়া।

বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “নুরুল হুদা দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার ছাত্র জীবনের শুরু থেকে আমি স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে দেখভাল করছি। তার লেখাপড়া চলমান রাখতে তাকে দুটি স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পারি, নুরুল হুদা চাকরি পেতে অসাধু কিছু ব্যক্তির কবলে পড়ে আর্থিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছে।

“নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার একটি স্লিপও আমার নজরে আসে। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে তার এহেন অসাধুকর্ম রোধে খোঁজ নেওয়ার জন্য তার স্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। কারণ হুদার স্ত্রীর বাড়ি সৈয়দপুরে। হুদার স্ত্রী সে সময় ব্যাংক লেনদেনের বিষয়টি স্বীকারও করে, তবে বিস্তারিত বলতে রাজি হয়নি।”

ওই নিয়োগের নির্বাচনী বোর্ডে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়াও ছিলেন বলে জানিয়েছেন আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল হান্নান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, নিয়োগ বোর্ডে উপ-উপাচার্য ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান, সিনেট সদস্য রুস্তম আলী, বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল এবং বিভাগের সভাপতি হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, “আমি নির্বাচনী বোর্ডে অংশ নিতে সেখানে গিয়েছিলাম। তবে অর্থের লেনদেন সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। কিংবা আদৌ কোনো অর্থ লেনদেন কারও সঙ্গে হয়েছে কি না সেটাও জানি না। তবে একটু গুজবের মতো শুনেছিলাম, অর্থ লেনদেন বিষয়ে।”

নাম না প্রকাশ করার শর্তে আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, ‘এই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দরকষাকষির তথ্য আমার কাছেও এসেছিল। সেটা ৩০-৪০ লাখ টাকার লেনদেনের একটি তথ্য তখন আমার কাছে এসেছিলো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, আইন বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ যে সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হয়েছিল সেখানে তিনি ছিলেন।

“এ নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ। আমার কাছে সবই সাজানো নাটক মনে হয়েছে। আগে থেকে সবই নির্ধারিত ছিল কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে। একটি ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বর্ণপদক পেল, আবার প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক পেল; তারপরেও চাকরি হল না। আমি বিস্মিত।”

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য নুরুল হুদা ও তার স্ত্রীকে কয়েক দফায় ফোন করা হয়। হুদা এক পর্যায়ে ফোন ধরলেও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

হুদা বলেন, “সকাল থেকেই এ বিষয়ে ফোন রিসিভ করতে করতে আমি বিরক্ত। আমি রাতে জার্নি করেছি। এখন একটু ঘুমাব। পরে ফোন দেন।”

তবে পরে একাধিকবার ফোন করেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। নুরুল হুদার স্ত্রীও আর ফোন ধরেননি।

উপ-উপাচার্যের এই ফোনালাপে ‘শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্যের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা’ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করছেন রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর।

“তার পদত্যাগের দাবিতে আজ সন্ধ্যায় মশাল মিছিল হবে।”

এই কর্মসূচিতে ছাত্র ফেডারেশনের নেতাকর্মীরাও অংশগ্রহণ করবেন বলে সংগঠনের সভাপতি রাশেদ রিমন জানিয়েছেন।