হামলাকারী ‘৫ জঙ্গি চিহ্নিত’; লক্ষ্য আলো-আঁধারিতে থাকা পুলিশ

এবছর ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে যে বোমা হামলাগুলো হয়েছিল, তাতে ৫ জঙ্গির জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যালনাল ক্রাইম ইউনিট।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2019, 12:03 PM
Updated : 24 Sept 2019, 12:11 PM

‘নব্য জেএমবি’র এই পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুজন ফতুল্লায় অভিযানের আগে গ্রেপ্তার হন; বাকি তিনজনকে এখনও ধরতে না পারলেও তাদের চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযানের পরদিন মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি।

ওই অভিযানে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে পুলিশের উপর হামলায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের মিল পাওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিলেন মনিরুল।

২০১৬ সালে গুলশান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে বিভিন্ন জেলায় অনেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মেলে এবং নিহতও হন শীর্ষ জঙ্গিনেতারা। তখন পুলিশ কর্মকর্তারা বলছিলেন, জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সম্প্রতি ঢাকায় পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েকটি বোমাহামলার পর ফের আলোচনা শুরু হয় জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে; এসব হামলার পর জঙ্গি সংগঠনের নামে দায় স্বীকারের বার্তার খবরও আসে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল থেকে পরবর্তী মাসগুলোতে পাঁচটি হামলা হয়। এগুলোতে জঙ্গিদের যোগসাজশের কথা বলা হলেও কারা তারা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছিল না।

এর মধ্যেই রোববার মধ্যরাতে ফতুল্লার সেয়াচর এলাকায় একটি বাড়ি ঘিরে অভিযান চালায় পুলিশ। বলা হয়, মিজানুর রহমান (মিশুক খান মিজান) নামে নব্য জেএমবির এক সদস্যকে ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর তার কাছে পাওয়া তথ্যে ওই অভিযান চলে।

ফতুল্লার ওই বাড়িতে তিনটি ইমপ্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের (আইইডি) পাশাপাশি বোমা তৈরির আরও বিস্ফোরক ও রাসায়নিক পাওয়া যায়।

ওই বাড়ির মালিকের ছেলে ফরিদউদ্দিন রুমিকে গ্রেপ্তার করা হয়। রুমি ঢাকার আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ও প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল বলেন, “এদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি যে, গত পাঁচটি ঘটনায় পাঁচজনের একটি সেল কাজ করেছে। এই পাঁচজনই পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং আইইডি তৈরি করেছে।”

মিজান ও রুমি ওই দলেরই দুজন জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বাকি তিনজনকেও চিহ্নিত করা হয়েছে।

“গ্রেপ্তারকৃত দুজনের উপরে একজন নেতা রয়েছে এবং তাদের একজন আমির আছে। তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।”

গত ২৯ এপ্রিল গুলিস্তানে পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর পর ২৬ মে মালিবাগে এসবি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের পিকআপ ভ্যানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

জুলাইয়ে রাজধানীর খামারবাড়ি ও পল্টনে পুলিশ বক্সের সামনে দুটি প্যাকেটে বোমা পাওয়া যায়। এরপর গত ৩১ অগাস্ট সাইন্সল্যাবে পুলিশ বক্সের সামমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।

গ্রেপ্তার মিজান ও রুমিকে গুলিস্তানে বিস্ফোরণের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজত চাওয়া হবে বলে মনিরুল জানান।

তিনি বলেন, “রুমি ও মিজান গুলিস্তানের ঘটনায় সরাসরি সম্পৃক্ত। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাকিদের সম্পর্কে তথ্য পাব এবং আর যে চারটি মামলা, সেগুলোর তদন্ত সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।”

গ্রেপ্তার মিজানুর রহমান ও ফরিদউদ্দিন রুমি

লক্ষ্য কেন পুলিশ?

কেন পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা হচ্ছে, সে বিষয়ে গ্রেপ্তার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য পাওয়ার কথা জানান মনিরুল।

তিনি বলেন, “নব্য জেএমবি সদস্যরা দেশের প্রচলিত আইনকানুন-সংবিধান বিশ্বাস করে না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ, এ কারণে 'আইডিওলজিক্যালি' তারা পুলিশকে শত্রু মনে করে।

“এছাড়া পুলিশের অভিযানের কারণে তাদের অনেক শীর্ষ নেতা মারা গেছে কিংবা গ্রেপ্তার হয়েছে; এ কারণেও তারা পুলিশকে শত্রু মনে করে।”

তিনি বলেন, ধারাবাহিক হামলা চালিয়ে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য।

খামারবাড়িতে পাওয়া বোমাটিতে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটায় পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিট

নারায়ণগঞ্জে যে তিনটি প্রস্তুত আইইডি উদ্ধার করা হয়, সেগুলো পুলিশের উপর নিক্ষেপ করা হত বলে জানান মনিরুল।

শুরুতে যে আইইডিগুলো তৈরি করা হয়েছিল, প্রশিক্ষণ না থাকায় সেগুলো নিম্নমানের হলেও ধীরে ধীরে এই জঙ্গিরা দক্ষ হয়ে উঠছিল বলে জানান তিনি।

“তাদের আইইডি তৈরির কোনো প্রাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা নাই। তবে আমরা দেখেছি ডিভাইসগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অর্থাৎ ২৯ এপ্রিল যেটি ব্যবহার করা হয়েছিল, ৩১ অগাস্ট এসে দেখেছি আরেকটু আরেকটু শক্তিশালী হয়েছে।

“গতকাল যে তিনটি ডিভাইস নারায়ণগঞ্জে ধ্বংস করা হয়েছে, সেটি আরও শক্তিশালী দেখা গেছে। অর্থাৎ তারা ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে এগুলো শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।”

হামলা আলো-আঁধারিতে

গত পাঁচ মাসে পুলিশের উপর যে পাঁচটি হামলা হয়েছে, সেগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন মনিরুল।

তিনি বলেন, “প্রত্যেকটি হামলার ঘটনা ঘটেছে রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে। আর প্রত্যেকটি ঘটনা মাসের শেষ দিকে অর্থাৎ ২০ তারিখের পরে ঘটেছে।”

সায়েন্স ল্যাবে পুলিশ বক্সে হামলা হয়েছিল গত ৩১ অগাস্ট

রাতে ও মাসের শেষে কেন হামলা করা হয়, সে বিষয়ে গ্রেপ্তার দুই জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা।

তারা জানিয়েছেন, মাসের শুরু থেকে তারা ‘রেকি’ করে লক্ষ্য ঠিক করার পর মাসের শেষ দিকে হামলা চালায় এবং  লক্ষ্য থাকে আলো-আঁধারিতে থাকা পুলিশ সদস্য।

মনিরুল বলেন, “মাসের শুরু থেকে তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়ায় এবং কোথায় নিরস্ত্র পুলিশ থাকে এবং কখন তারা বক্সে যায় এসব বিষয় রেকি করে। আর রাতের ওই সময়টা আলো-আঁধার থাকে বলে তারা ওই সময়টি বেছে নেয়।”

এসব ঘটনায় যে আইইডি ব্যবহার করা হয়েছে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দূর নিয়ন্ত্রিক অর্থাৎ রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বলে জানান মনিরুল।