গ্রামে ডেঙ্গু নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ বিশেষজ্ঞদের

এতদিন ঢাকাবাসীর কাছে আতঙ্ক হয়ে থাকা ডেঙ্গুর জীবাণু এবার ছড়িয়েছে সারা দেশে, যা ভবিষ্যতে এই রোগের বিস্তার ঠেকানো নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2019, 05:05 PM
Updated : 31 August 2019, 03:54 AM

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগের জন্য দায়ী দুটি মশার একটি এইডিস অ্যালবোপিকটাস। এই মশা গ্রামে বেশি থাকে। এবার ‘উপযোগী পরিবেশ’ পাওয়ায় এইডিস ইজিপ্টির পাশাপাশি এই মশাও রোগটা ছড়িয়েছে।

এ কারণে আগামীতে ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বাইরে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে তারা বলছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন থেকে গ্রাম পর্যায়েও কার্যক্রম চালাতে হবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা- আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণই ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়।

“তাই এতদিন যেটা ঢাকায় করা হত, এখন সেটা ঢাকার বাইরেও করতে হবে।”

ঢাকায় এইডিস ইজিপ্টি ডেঙ্গু ছড়ালেও গ্রামে তা ছড়াচ্ছে এইডিস অ্যালবোপিকটাস

২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেওয়ার পর ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫০ হাজার ১৪৮ জনের এই রোগের চিকিৎসা নেওয়ার তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে সরকারের খাতায়। এরমধ্যে ঢাকার বাইরের রোগী ছিল ১৫৮ জন।

সেখানে এ বছর জানুয়ারি থেকে ৩০ অগাস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ২৯ হাজার ৯১ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬৯ হাজার ৪৩৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকায় ৪০ হাজার ৩৪৪ জন। ঢাকার বাইরে আক্রান্তের সংখ্যা মোট ভর্তি রোগী অর্ধেকের কাছাকাছি, ৪১ দশমিক ৮৯ ভাগ।

সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের একটি বড় অংশই ঢাকা ফেরত হলেও অনেকেই কখনও বা সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে আসেননি বলে জানা গেছে।

এ বছর ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে যাদের মৃত্যুর খবর এসেছে তাদের অনেকের ক্ষেত্রেই নিজের এলাকায় থেকেই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য এসেছে।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন সব বয়সীরা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫২ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল এবং জেলা চিকিৎসকদের কাছ থেকে ডেঙ্গুতে অন্তত ১৮৯ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। এরমধ্যে ৪৮ জনই মারা গেছেন ঢাকার বাইরে। শতকরা হিসেবে তা মোট মৃতের ২৫ দশমিক ৩৯ ভাগ।

এর আগে ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যে ২৯৮ জন মারা গিয়েছিলেন তাদের তিনজন ছিলেন ঢাকার বাইরের। এরমধ্যে ২০১৭ সালে কুমিল্লা ও শরীয়তপুরে দুজন এবং ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে একজন মারা যান।

২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোনো ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০১৬ সালে সারা দেশে ছয় হাজার ৬০ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৩৭ জন ছিলেন ঢাকার বাইরের। ২০১৭ সালে দুই হাজার ৭৬৯ জনের মধ্যে ঢাকার বাইরে ১১৬ জন এবং ২০১৮ সালে সারা দেশে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরে শনাক্ত হয়েছিলেন।

ঢাকার বাইরে এবার এত বেশি ডেঙ্গু রোগী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী অপর মশা এইডিস অ্যালবোপিকটাস গ্রামে বেশি থাকে।

“এতদিন গ্রামে মশা ছিল, কিন্তু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল না। আক্রান্ত ব্যক্তি হচ্ছেন সোর্স অফ ইনফেকশন। তো, মশা যখন আক্রান্ত মানুষকে কামড়েছে জীবাণুটা তার শরীরে ছড়িয়েছে। এইভাবে একসঙ্গে অনেক মানুষ যেহেতু গ্রামে গেছে এ কারণে গ্রামে ডেঙ্গুর পরিমাণটাও বেড়েছে।”

এবার ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় মশা প্রজননের ‘সবচেয়ে উপযোগী’ পরিবেশ পেয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকার মতো গ্রামেও মশা নিধনের ব্যবস্থা না নিলে আগামীতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মশার প্রজনন উৎসের পার্থক্যের বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ঢাকায় কৃত্রিম এবং ঢাকার বাইরে মশা প্রজননের প্রাকৃতিক উৎস বেশি। গ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশেও এইডিস মশার সোর্স থাকতে পারে। যেমন মাটির হাড়ি, ভাঙা কলসি, ডাবের খোসা এসব গ্রামে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া বাঁশের কোরল, গাছের কোটর, কচুগাছ বা কলাগাছের ডগা যেখান থেকে বের হয় এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতেও মশা জন্মাতে পারে। এ কারণে এইডিস অ্যালবোপিকটাস যেসব জায়গায় ডিম দিতে পারে সেসব জায়গায় নজর দিতে হবে।

এইডিস অ্যালবোপিকটাস এবার ‘উপযোগী পরিবেশ’ পাওয়ায় ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গুর জন্য এইডিস ইজিপ্টি ৯৫ ভাগ এবং এইডিস অ্যালবোপিকটাস ৫ ভাগ দায়ী।

“অ্যালবোপিকটাসটা এপিডেমিক কন্ডিশনে রোগের ভেক্টর (বাহক) হয়ে যায়। আমার মনে হয়, এবার এটা ভেক্টরিয়াল ক্যাপাসিটি পেয়ে গেছে। এবারের এই এপিডেমিকাল কন্ডিশনে অ্যালবোপিকটাস ভেক্টরিয়াল রোল প্লে করেছে বলে গ্রামে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে বেশি।”

আগামী বছর গ্রাম পর্যায়ে ডেঙ্গু বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করে ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রতিটি জায়গায় মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন এই কীটতত্ত্ববিদ।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, এইডিস অ্যালবোপিকটাসের আরেকটা ভয়ঙ্কর দিক হল, এই মশা যে ডিম পাড়ে তাতেও ভাইরাসটা ট্রান্সফার হয়।

“এ কারণে আগামী বছর শহরে কমলেও গ্রামে ডেঙ্গু রোগ বাড়তে পারে। কারণ এই মৌসুমে অনেকে আক্রান্ত হওয়ার কারণে মশা এই ভাইরাসটা পেয়ে গেছে, সেই সাইকেলটা থাকবে।”

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যক্রম হাতে নিচ্ছেন তারা।

আগামীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ এইডিস মশা নির্মূলে ‘সবচেয়ে বেশি জরুরি’।

“জনসচেতনতা আমরা আগের চেয়ে মনে হয় কিছুটা বাড়াতে পেরেছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা এখন দুইটা কাজ করব, ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং এইডিস মশার লার্ভা নিধনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। কারণ এই মশা উৎসে নির্মূল করতে পারলে আমি মনে করি একটা ভালো অর্জন হবে।”

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমরা এ বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণালব্ধ জ্ঞান এক জায়গায় করছি। এগুলো করে আমরা মশা নিধনে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা নেব। সে অনুযায়ী সারা বছর কাজ করা হবে।”