মিন্নির জামিন প্রশ্নে রায় বৃহস্পতিবার

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় তার স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি জামিন পাবেন কি না- তা জানা যাবে বৃহস্পতিবার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2019, 10:48 AM
Updated : 28 August 2019, 12:53 PM

মিন্নির জামিন প্রশ্নে জারি করা রুলের ওপর বুধবার শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য রাখে।

মিন্নির পক্ষে এদিন হাই কোর্টে শুনানি করেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না, মনসুরুল হক চৌধুরী, অনীক আর হক, মাক্কিয়া ফাতেমা ইসলাম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারোয়ার হোসাইন বাপ্পী।

আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুনানিতে রিফাত হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজের কয়েকটি সিডি দাখিল করে মিন্নির জামিন চান।

তিনি বলেন, “ভাইরাল হওয়া সিসিটিভি ফুটেজকে পুলিশ ১১টা ভাগে ভাগ করে দেখাতে চাচ্ছে মিন্নি তার স্বামীকে বাঁচানোর অ্যাকটিং করেছেন। অথচ পুরো ভিডিওটা দেখলে বোঝা যায় সে কতটা চেষ্টা করেছে স্বামীকে বাঁচাতে। তাছাড়া অরেকটি কথা হচ্ছে, ফুটেজটি পুলিশের কাছ থেকে কীভাবে প্রচার হল?

“১৯ বছরের একটা মেয়ে। দুই-তিন মাস হয় কলেমা পড়ে বিয়ে হয়েছে। সে এখন বিধবা। জামিন পেলে সে তদন্তকাজে বিঘ্ন ঘটাবে না। তার পালানোর সুযোগ নেই। আমরা আর কিছু চাচ্ছি না, শুধু জামিন চাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জামিনদার থাকব।” 

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবিরও এদিন আদালতের তলবে শুনানিতে হাজির ছিলেন। তাকে ডায়াসে ডেকে নিয়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক জানতে চান- তদন্তের অবস্থা কী?

জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “একেবারে শেষ পর্যায়ে আছি। মহামান্য আদালত যেহেতু নির্দেশ দিয়েছেন হাজির হতে তাই আজ দাখিল করতে পারিনি।”

বিচারক তখন জানতে চান- তদন্ত কর্মকর্তা কবে ঢাকায় এসেছেন। হুমায়ুন কবির উত্তরে বলেন, তিনি এসেছেন মঙ্গলবার।

বিচারক তখন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা  কয়েকদিন আগে ঢাকায় এসেছেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। উত্তরে হুমায়ুন কবির বলেন, ওই তথ্য ঠিক না।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “এ মামলার আসামি নয়ন বন্ড কি গ্রেপ্তার হয়নি? বন্দুকযুদ্ধে না কীভাবে যেন মারা গেল?”

তদন্ত কর্মকর্তা তখন বলেন, “আমাদের উপর আক্রমণ হয়েছিল। গ্রেপ্তার করতে পারিনি।

বিচারক তখন বলেন, “আপনাদের উপরই আক্রমণ হয়।”

এরপর কেইস ডকেট (মামলার নথি) দেখে বিচারক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে শব্দ না করে কিছু একটা পড়তে বলেন।

পড়া শেষ হলে বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি মনে করেন যে পুলিশের কাছে মিন্নি স্বীকার করেছে? আমরাতো দেখছি যে সব এড়িয়ে গেছে।”

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “প্রাথমিকভাবে দোষ স্বীকার করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়।”

বিচারক তখন বলেন, “ঘটনার সঙ্গে তার (মিন্নি) সম্পৃক্ততা থাকতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু তার বিষয়ে এসপি সাহেবের সংবাদ সম্মেলনে যা বলা হল, তার সঙ্গে নথির মিল দেখছি না।”

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “এসপি সাহেব নিজে থেকে বলেননি। সাংবাদিকরা  প্রশ্ন করেছে। এর জবাব দিয়েছেন তিনি।”

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, “প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছে মিন্নি ঘটনায় দোষ স্বীকার করেছে কি-না? এসপি সাহেব বলছেন, ‘করেছে’। যে কথা আগেই চলে আসল, আর কোনো ধরনের কোনো কথা এখানে আছে কিনা।”

জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, “সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে (এসপি ওই কথা) বলেছেন। খুবই চাঞ্চল্যকর মামলা। সারা দেশে চাঞ্চল্যে সৃষ্টি করেছে। এসপি সাহেব তার দায়িত্বই পালন করেছেন।”

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম তখন বলেন, “যার জায়গা যত বড়, তার দয়িত্বও তত বড়। তাকে সে অনুযায়ী সচেতন থাকতে হয়।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. সারোয়ার হোসাইন বাপ্পী এরপর মিন্নির জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, “আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি ঘটনার পরিকল্পনাকারী। তার কারণে দুইটা প্রাণ গেছে। তাছাড়া ঘটনার (রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের) আগে পরে সে ১৩ বার নয়ন বন্ডের সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে। ঘটনার আগে ৮ বার এবং ঘটনার পরে ৫ বার।

“তাছাড়া এখনো এ মামলায় অভিযোগপত্র জমা পড়েনি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে যেন জামিন দেওয়া না হয়।”

অন্যদিকে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, “একটা মেয়ে কার কাছে কল করেছে, কি কথা হয়েছে, সেটা ইনকামিং না আউট গোয়িং আমরা জানি না। নয়ন বন্ড মারা যাওয়ার আগে পুলিশের জনৈক এসআইয়ের সাথে তার ৭৭ বার কথা হয়েছে।”

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী শুনানিতে অংশ নিয়ে মিন্নির জামিনের পক্ষে মত দেন।

তিনি বলেন, “তদন্ত যেহেতু শেষ পর্যায়ে, মেয়েটার বয়সও ১৯ বছর। তার (মিন্নির) বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত করার অভিযোগ নাই। তদন্তে অনেক তথ্য প্রমাণ হয়ত আসবে। সে তার স্বামীকে হারিয়েছে। আমার মনে হয় না তাকে জামিন দিলে প্রসিকিউশন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

“তাছাড়া জামিনের সাথে মামলার তদন্তের কোনো সম্পর্ক নাই। সে যদি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতও থাকে, তবে তো সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়ার সুযোগ রয়েছেই।”

গত ২৬ জুন রিফাতকে বরগুনার রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সে সময় স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির চেষ্টার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়।

পরদিন রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন; তাতে প্রধান সাক্ষী করা হয়েছিল মিন্নিকে।

পরে মিন্নির শ্বশুর তার ছেলেকে হত্যায় পুত্রবধূর জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করলে ঘটনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

গত ১৬ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদের পর এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

পরদিন আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে পাঠান। রিমান্ডের তৃতীয় দিন শেষে মিন্নিকে আদালতে হাজির করা হলে সেখানে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানায়।

তার আগের দিনই পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, “মিন্নি হত্যাকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই হত্যা পরিকল্পনার সঙ্গে মিন্নির যুক্ত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।”

বরগুনা সরকারি কলেজের স্নাতকের এই ছাত্রী পরে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে।

মিন্নির বাবা অভিযোগ করে আসছেন, ‘নির্যাতন করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে’ মিন্নিকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে পুলিশ। এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের হাত আছে বলেও তার দাবি।

বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত এবং জেলা ও দয়েরা জজ আদালতে মিন্নির জামিন আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পর গত ৫ অগাস্ট হাই কোর্টে জামিন আবেদন করেন তার আইনজীবীরা।

গত ৮ অগাস্ট বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের অবকাশকালীন হাই কোর্ট বেঞ্চে আংশিক শুনানির পর জামিন পাওয়ার আশা না দেখে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্না আবেদন ফিরিয়ে নেন এবং পরে চারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে আবেদন করেন।

এ বিষয়ে আংশিক শুনানি নিয়ে আদালত গত ২০ অগাস্ট রুল জারি করে। মিন্নিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না- তা সাত দিনের মধ্যে সরকারকে জানাতে বলা হয়।

পাশাপাশি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবিরকে যাবতীয় নথিপত্রসহ ২৮ অগাস্ট শুনানির দিন আদালতে হাজির থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সরকারের জবাব পাওয়ার পর বুধবার রুল শুনানি শেষে আদালত বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দিল।