এটা মিয়ানমারের ব্যর্থতা: বাংলাদেশ

বাংলাদেশ বলেছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে ফিরতে অনাগ্রহের মূলে রয়েছে প্রতিশ্রুতি পূরণে মিয়ানমার সরকারের ‘ব্যর্থতা’।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 August 2019, 06:02 PM
Updated : 25 August 2019, 06:38 PM

রোহিঙ্গা সঙ্কটের দুই বছর পূর্তির দিন রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য দুই দেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানে বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করার পুরো দায়িত্ব ছিল মিয়ানমারের ওপর।   

“সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাখাইনে (রোহিঙ্গাদের ফেরার) উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং বস্তুনিষ্ট তথ্য দিয়ে, রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি জানিয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থার সঙ্কট কমিয়ে আনা ছিল মিয়ানমারের দায়িত্ব।

“সুতরাং, উদ্বিগ্ন মানুষগুলোর অনাগ্রহের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় ব্যর্থতার দায় মিয়ানমার সরকারের ওপরই বর্তায়।”

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা; এই সংখ্যা কিছু দিনের মধ্যে সাত লাখ ছাড়ায়। আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। 

তাদের কক্সবাজারের কয়েকটি কেন্দ্রে আশ্রয় দিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় জরুরি মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও নানা কারণে প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হতে থাকে।

শেষ পর্যন্ত গতবছর ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর তারিখ ঠিক হলেও নতুন করে নিপীড়নের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থেকে রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

এরপর দুই সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পাঠানো তালিকা থেকে ৩ হাজার ৪৫০ জনকে রাখাইনের অধিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের ফেরত নিতে রাজি হওয়ার কথা জানায় মিয়ানমার।

কিন্তু চারটি দাবি এবং রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে ওই তালিকায় থাকা কেউ স্বেচ্ছায় ফিরতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরুর দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও গত ২২ অগাস্ট মুখ থুবড়ে পড়ে। 

রোহিঙ্গাদের দাবি, প্রত্যাবাসনের জন্য আগে তাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে। জমি-জমা ও ভিটেমাটির দখল ফেরত দিতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাখাইনে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে, সেজন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

মিয়ানমার অভিযোগ করে আসছে, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার পরও বাংলাদেশের ‘অসহযোগিতার’ কারণে এখনও প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।

তাদের এই দাবিকে ‘পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত’ আখ্যায়িত করা হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।

সেখানে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন চুক্তির আলোকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এ সমস্যা মেটাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি কফি আনান কমিশন রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নয়নে যেসব সুপারিশ করেছিল, রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তার বাস্তবায়ন করতে হবে।   

“রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে আগ্রহী হয়, সেজন্য তাদের সম্ভাব্য সব দিক দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেওয়ার দায়িত্বও মিয়ানমারকেই পালন করতে হবে।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মিয়ানমার বার বার তাদের দিক থেকে সব প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলার পর এবং তাদের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে যাওয়ার পরই ২২ অগাস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর প্রস্তুতি নিয়েছিল বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের পাঠানো ৩ হাজার ৪৫০ জনের তালিকা ধরেই ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সাক্ষাৎকার শুরু করা হয়েছিল, যেখানে রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল- স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে আগ্রহী কি না।

প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য নিরাপত্তা ও যানবাহনের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। ২২ অগাস্ট পর্যন্ত মোট ৩৩৯টি পরিবারের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার শেষ হয়েছিল।

“মিয়ানমার সরকারের দেওয়া সব তথ্য ওই সাক্ষাৎকারের সময় উদ্বিগ্ন পরিবারগুলোকে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তাসহ সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে, যাতে তারা তাদের মনোভাব নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে।

“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেসব পরিবারের কেউ বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। তারা মনে করছে, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি এখনও তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের অনুকূল নয়।”

বিবৃতিতে বলা হয়, সাক্ষাৎকারে প্রায় সব রোহিঙ্গা পরিবারই রাখাইনের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।

“অধিকাংশ পরিবার নাগরিকত্ব, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং ভূমির মালিকানাসহ তাদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো এবং সুবিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা বলেছে।

“সাক্ষাৎকার দেওয়া পরিবারগুলোর সবাই বলেছে, মিয়ানমার সরকার যখনই তাদের দাবিগুলো পূরণ করবে, তখনই তারা ফিরে যেতে আগ্রহী।”

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে মিয়ানমারকে আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ বিষয়ে তাদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।