শরণার্থী জীবনের দুই বছর

মিয়ানমারের রাখাইনের একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন সৈয়দুল করিম। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর জ্বলন্ত বাড়িঘর আর বন্ধু-স্বজনের লাশ পেছনে ফেলে নয় দিনের ভয়ঙ্কর এক যাত্রায় তিনি পৌঁছান কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে।

মাসুম বিল্লাহ কক্সবাজার থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 August 2019, 05:27 AM
Updated : 25 August 2019, 05:27 AM

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর করিমের মত লাখো রোহিঙ্গার ঢল নেমেছিল বাংলাদেশ সীমান্তে। বাংলাদেশের মানুষ আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তায় কক্সবাজারের কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্রে তাদের ঠাঁই হয়েছে, খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে।

কিন্তু করিমদের শরণার্থী জীবনের ক্লেশ আর অনিশ্চয়তার অবসান হয়নি দুই বছরেও।

মা আর ছোট চার ভাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের পথ ধরেছিলেন করিম। পথে সদ্য ভূমিষ্ঠ একটি মেয়ে শিশুকে পেয়ে তাকেও সঙ্গে নিয়ে নেন। এখন কুতুপালংয়ের চার নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি ঘরে ছয় সদস্যের এই পরিবারের সংসার।

পড়ালেখা জানায় অন্য অনেকের চেয়ে ‘সৌভাগ্যবান’ এখন করিম গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মীর কাজ পেয়েছেন। ৪ নম্বর ক্যাম্পের লাগোয়া একটি চা দোকানে শনিবার সন্ধ্যায় কথা হয় এই ১৯ বছর বয়সী তরুণের সঙ্গে।

শরণার্থী জীবনে কষ্টের বর্ণনা দিয়ে করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিজের দেশ থেকে অন্যের দেশে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। ক্যাম্পই এখন আমাদের সব। এখানেই আমাদের থাকা খাওয়া সব কিছু। আমরা যে ফিরে যাব, সেই ব্যবস্থাও তো হল না।”

গত দুই বছরে অন্তত সাত লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে; এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে।

কিন্তু ফের নিপীড়িত হওয়ার শঙ্কা আর মিয়ানমার সরকারের প্রতি রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাসে প্রত্যাবাসনের দুই দফা চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

এদিকে শরণার্থীদের নিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের মনোভাবও ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে।

‘ক্যাম্পবন্দি’

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কুতুপালংয়ে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া এলাকা রোহিঙ্গাদের দোকান ঘিরে বেশ জমজমাট।

ক্যাম্প ঘিরে নিজেদের আলাদা সমাজ গড়ে তুলেছেন রোহিঙ্গারা। ৩৪টি ক্যাম্পের প্রতিটিতে তাদের নিজস্ব নেতৃত্বের কাঠামো রয়েছে। ক্যাম্প ইনচার্জের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি ক্যাম্পে নির্বাচিত একজন চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রতি ব্লকে রয়েছেন একজন করে নেতা, যাকে মাঝি বলে ডাকেন রোহিঙ্গারা।

শনিবার বিকালে ওই আশ্রয় শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের আড্ডা-গল্প আর বিকিকিনিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। একটি দোকানে রোহিঙ্গা ভাষায় গানও পরিবেশন করছিলেন একদল। ১ নম্বর ও ২ নম্বর ক্যাম্পের দুই জায়গায় বল নিয়ে খেলতে দেখা যায় রোহিঙ্গা তরুণদের।

ছেলের হাত ধরে ২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের পথ ধরেন ৬৩ বছর বয়সী জহুরা খাতুন। ছেলে, ছেলের বউ এবং তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে কুতুপালংয়ের একটি ঘরে জায়গা হয়েছে স্বামী হারা এই নারীর।

সারাদিন নামাজ-কালাম কিংবা কোরান শরিফ পড়ে ক্যাম্পঘরে সময় কাটে তার। শনিবার সন্ধ্যায় তার ঘরে গেলে কোরান শরীফ পড়ছিলেন জহুরা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”নাতিরাতো ক্যাম্পে ঘোরাফেরা করে সময় পার করে দেয়। ছেলে একটা এনজিওতে দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। কিন্তু আমিতো এখানে বন্দি।”

বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া ত্রাণ থেকে খাবারের ব্যবস্থা হয় জহুরাদের। ছেলে এনজিওতে কাজ করে যা পায়, তাই দিয়েই অন্য খরচ মেটানোর চেষ্টা করতে হয়।

“আমরা নিজের ভিটায় ফিরতে চাই। কিন্তু যে অবস্থা, তাতে ফেরাতো সম্ভব না। নাগরিকত্ব আর রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দিয়ে নিরাপত্তা দিলে আমরা যাব।”

উখিয়ায় কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের বাইরে টেকনাফেও আছে সাতটি ক্যাম্প। যেখানে প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে রাখা হয়েছে।

মিয়ানমারের মংডুতে একটি মসজিদে তাবলীগ জামাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর গোলাগুলির মুখে পড়েছিলেন মোহাম্মদ গফুর। সেদিন চোখের সামনে আটজনকে গুলি খেয়ে মরতে দেখেছেন তিনি। গুলি লেগেছিল তার গায়েও, তবে কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে আসতে পেরেছিলেন।

মসজিদ থেকে সেদিন বাড়ি ফিরে গফুর দেখেন, স্ত্রী, সাত ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। এরপর আরও অনেক রোহিঙ্গার মত তিনিও বাংলাদেশ সীমান্তের পথ ধরেন।

টেকনাফে এসে নিখোঁজদের তালিকা ধরে খুঁজে শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সন্ধান পান গফুর। এখন টেকনাফের শালবাগানে ২৬ নম্বর ক্যাম্পে জায়গা হয়েছে তাদের। তিন ছেলে এনজিওর ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে। চার মেয়ে ঘরেই থাকে।

শরণার্থী জীবনের অনিশ্চয়তা আর শত কষ্টের পরও মিয়ানমারে আবার ‘মৃত্যুর মুখে’ ফিরে যাওয়ার কোনো যুক্তি দেখেন না এই রোহিঙ্গা।

“আঁর মুনতু ৮ জন মরিগিয়েদে দেখখি। আল্লাহ আরে বাচেইয়ে, আই দুবারা এরে কিয়ল্লিই যাইয়ুম? ইয়ান আর দেশ ন, মানিলাম, আই কি তইলে মরি যাইয়ুম?”

রাখাইনের দরিয়াপাড়া থেকে এসেছেন রোহিঙ্গা নারী নূর জাহান। নয় ছেলে-মেয়ে আর স্বামীর সঙ্গে শালবাগান ক্যাম্পে থাকেন তিনি। এর মধ্যে দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে আসার পর ক্যাম্পের দুই বছরে।

ক্যাম্পগুলোতে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। আবার সন্তান প্রাপ্তিকে ‘আল্লাহর দান’ হিসাবে মনে করেন নূর জাহানের মত অনেক রোহিঙ্গা।

ছোটো ছোট সন্তানদের নিয়ে ক্যাম্পে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানেও হামলা হতে পারে। শালবাগান ক্যাম্পে অনেক সময় গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়।”

পাঁচ লাখ শিশুর অনিশ্চিত জীবন

ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ‘নির্ভরশীল’ জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা।

শিক্ষা ও কাজের অভাবে শরণার্থী কিশোর তরুণদের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আর উগ্রবাদে জড়ানোর ঝুঁকিও আছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৩২ জন শিশু বসবাস করছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজারের জন্ম হয়েছে ক্যাম্পেই।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, এদের মধ্যে ৩ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু প্রায় তিন লাখ। ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৪ থেকে ১৪ বছর বয়সী ২ লাখ ৮০ হাজার শিশু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়েছে। প্রায় ২৫ হাজার শিশুর কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ হয়নি।

অন্যদিকে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের ৯৭ শতাংশই শিক্ষার বাইরে থাকছে জানিয়ে ইউনিসেফ বলছে, অপরাধ, শিশুশ্রম, মানব পাচার ও বাল্যবিবাহের মতো ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে এরা।

১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের শিক্ষার সুযোগ না থাকায় কেউ কেউ নিজস্ব উদ্যোগে পড়ালেখা শুরু করেছেন। তাদেরই একজন ১৫ বছর বয়সী আকতার হোসেন।

ক্যাম্পের ভেতরে ‘প্রাইভেটে’ মিয়ানমারের অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পড়ছেন তিনি। অবশ্য তাতে সার্টিফিকেট পাবেন কি-না. বা পেলেও কীভাবে পাবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয় আকতার।

বার্ষিকীতে সমাবেশের প্রস্তুতি

রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্তিতে এসে বড় ধরনের সমাবেশের প্রস্তুতি নিয়েছে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত এই শরণার্থীরা। কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের বর্ধিত অংশের মাঠে হবে এই সমাবেশ।

রোববার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ওই সামবেশে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন আয়োজকরা।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামক সংগঠনের চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ বলেন, “বিশ্ববাসীর সামনে রোহিঙ্গাদের দাবি তুলে ধরতে চাই আমরা। আমরা জানিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমারে আমাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে এবং ভিটেমাটি ফিরিয়ে আমাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে।

এই রোহিঙ্গা নেতা জানান, রোহিঙ্গাদের নিজস্ব রীতির সাদা পোশাকে সমাবেশে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে খবর পৌঁছানো হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে।

সবার হাতে থাকবে পতাকা, ব্যানার-পোস্টার এবং প্ল্যাকার্ড। দোয়া মাহফিল হবে নিহত রোহিঙ্গাদের জন্য। রোহিঙ্গা ভাষায় ধর্মীয় সংগীতের পাশাপাশি বক্তব্য দেবেন নেতারা। শিক্ষার্থী ও নারীরা হাজির হবেন আলাদা পরিবেশনা নিয়ে।

প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতিকে ’প্রতারণা’ হিসাবে বর্ণনা করে মুহিব উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মুখ রক্ষার জন্য আমাদের ফেরানোর কথা বলছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা ফেরানোর কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। রোহিঙ্গাদের জায়গা এখনও নিরাপদ নয়।

”যদি বাংলাদেশের ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে এখানকার ক্যাম্পই আমাদের জন্য ভালো। মিথ্যা অভিযোগের বেসাতি করছে মিয়ানমার, রোহিঙ্গাদের ফেরানোর কোনো ইচ্ছা তাদের নেই।”